ভোটে আগ্রহ হারাচ্ছেন ময়মনসিংহের নারীরা

প্রকাশিত: ৬:০৭ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৬, ২০২৩

শিল্পী সরকার :

স্বাধীনতার দীর্ঘকাল পরে হলেও ময়মনসিংহকে বিভাগ করা হয়েছে। নব গঠিত বিভাগীয় জেলায় বাড়ছে নতুন নতুন প্রশাসনিক পদ পদবী। সেই সাথে বাড়ছে জনপ্রতিনিধির গুরুত্ব। কিন্তু তাতে তেমন সুখবর নেই নারী সমাজের জন্য। বরং ভোটাধিকারে পিছিয়ে রয়েছে দেশের অন্যতম প্রাচীন এ জেলার নারীরা। জনপ্রতিনিধি হওয়া থেকে শুরু করে প্রতিনিধি নির্বাচনে অধিকার প্রতিষ্ঠার নিয়ামক “ভোটার” হওয়ার ক্ষেত্রেও নারী সমাজের অনাগ্রহের চিত্র ফুটে উঠেছে গত কয়েকটি সংসদ নির্বাচনের তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ এ অঞ্চলে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর নেত্রী বা কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারা, নানাভাবে নারীদের হয়রানী, পুরুষদের কর্তৃত্বমূলক মনোভাব, আর নিজের অধিকার সম্পর্কে অসচেতনতা এর অন্যতম কারণ। তবে সাধারণ নারীরা এ জন্য অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন অতীতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। তারা বলেছেন, জনপ্রতিনিধিদের বিরূপ মনোভাব, অবমূল্যায়ন এবং এড়িয়ে চলার কারণে ভোটার হওয়া কিংবা ভোট দেয়ায় অনেক নারী নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। তবে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, নারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও আগ্রহ বাড়াতে ইসি প্রচার প্রচারনা মূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে।

বাংলাদেশের অষ্টম বিভাগীয় শহর ও ১২তম সিটি কর্পোরেশন ময়মনসিংহ জনসংখ্যার দিক থেকে অষ্টম বৃহত্তম মহানগর। আসছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এরই মধ্যে চুড়ান্ত ভোটার তালিকা হয়েছে। মোট ভোটার হয়েছেন ৪৪ লাখ ৪০ হাজার ২১১ জন। এর মধ্যে ২২ লাখ ৩৯ হাজার ১৬০ জন পুরুষ ভোটার। আর নারী ভোটার ২২ লাখ ১ হাজার ১৬ জন। শতকরা হার বিবেচনায় ৫০.৪৩% পুরুষ আর ৪৯. ৫৭% নারী ভোটার হয়েছেন। অর্থাৎ পুরুষের চেয়ে দশমিক ৮৬ ভাগ নারী ভোটার কম।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৩৭ লাখ ৫১ হাজার ১২১জন। এর মধ্যে পুরুষ ও নারী ভোটার ছিলো যথাক্রমে ১৮ লাখ ৯৩ হাজার ২১১জন এবং ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৯১০জন। শতকরা হার বিবেচনায় ৫০.৪৭% পুরুষ আর ৪৯. ৫৩% নারী ভোটার হয়েছিলেন। সেসময় পুরুষের চেয়ে দশমিক ৯৪ ভাগ নারী ভোটার কম ছিলো। ভোটারের শতকরা হিসেবে এ ব্যবধান বড় আকার নাহলেও ভোট দিতে যান আরো অনেক কম নারী। নির্বাচনের দিন এক একটি কেন্দ্রে পুরুষ ভোটারদের অনেকগুলো লাইন হলেও নারী ভোটারদের লাইন দেখা গেছে এক বড় জোর দুই। তবে নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচন নিয়ে কাজ করা এনজিও বা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এর প্রকৃত হিসেব না পাওয়ায় তার চিত্র গুলো জানা যায়নি।

দ্বাদশ নির্বাচনে ভোটার বিশ্লেষনে আরো দেখা গেছে, ময়মনসিংহ বিভাগে ১১ টি আসনের মধ্যে মাত্র তিনটি আসনে নারী ভোটার পুরুষ ভোটারের চেয়ে বেশী। আর তা হচ্ছে ময়মনসিংহ- ১ এ ৮৫৭ জন, ময়মনসিংহ -৪ এ ৪ হাজার ৬৮০ জন এবং ময়মসসিংহ-১১ তে ১ হাজার ৩৭৯ জন নারী ভোটার রয়েছেন পুরুষ ভোটারের চেয়ে বেশী। অন্যদিকে ৮ টি আসন অর্থাৎ ময়মনসিংহ- ২, ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ও ১০ আসন গুলোতে পুরুষের চেয়ে অনেক কম নারী ভোটার হয়েছেন। এর মধ্যে ময়মসসিংহ-১০ আসনেই পুরুষের তুলনায় সাড়ে ৯ হাজারের ওপর কম নারী ভোটার হয়েছেন।

নারী জনপ্রতিনিধি:
ময়মনসিংহ জেলার ১১টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ময়মনসিংহ সদর-৪ আসনে একমাত্র নারী রওশন এরশাদ দলীয় মনোনয়ন পান। তিনি ১৯৯৬ সালে ময়মনসিংহ সদর-৪ আসনে এবং ২০১৪ ও ২০১৮ সালে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হন। আর কোন সংসদীয় আসনে নারী প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হয় নাই। এছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারী কাউন্সিলররা নির্বাচন করলেও নারীদেরকে সরাসরি ভোটে অংশগ্রহণের জন্য দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয় না বললেই চলে। নারী ভোটারদের জন্য এটাও একটি বড় নেতিবাচক ফ্যাক্টর।

কেনো নারী ভোটার কম:
নারী ভোটার ও নারী নেত্রীদের সাথে সরেজমিনে কথা বলে জানা গেছে, সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য একটি কারণ। নারীরা কোন কাজে জনপ্রতিনিধিদের কাছে গেলে তাদের গুরুত্ব দেয়া হয়না। একজন পুরুষ যে ভাবে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে সহজেই তার অধিকার আদায় করতে পারেন, নারীরা তা পারেননা। ভোট দেয়ার আগে পরে ভয় ভীতি দেখানো হয় অর্থাৎ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তারা। নারীদের ইচ্ছা মতো নয় বরং পরিবার বা পুরুষের পছন্দ মতো ভোট দিতে হয়। সেক্ষেত্রে ভোট দেয়া বা ভোটার হওয়ায় তারা আগ্রহ হারাচ্ছেন। সেই সাথে শিক্ষা কম ও নিজ অধিকার সর্ম্পকে সচেতনতা না থাকাও অন্যতম কারণ।

কি বললেন নারী ভোটার ও নারী নেত্রীরা:
আউটার স্টেডিয়ামের গৃহিনী রহিমা খাতুন (৭০) জানান, অনেক বার ভোট দিয়েছি, ভোট শেষ হলে আমাদের কোন খোজখবর রাখে না, কোন ভাতার কার্ড বা সুযোগ-সুবিধার জন্য গেলে কথাই বলতে চায়না জনপ্রতিনিধিরা। কোন কোন সময় বলে বাড়ীর পুরুষদের পাঠিয়ে দিয়েন পরে দেখবো নে।

সবজি ব্যবসায়ী পুর্ণিমা ষোঘ (৩৫) বলেন, আমাদের শুধু ভোটের প্রয়োজন, ভোট শেষ আমাদের প্রয়োজন শেষ। কখনো জিজ্ঞাসাও করে না আমরা কেমন আছি। আর মন চায়না ভোট দিতে। হতাশ সুরে তিনি বলেন,”আমরা না দিলেও পাশ করে, ভোট দিয়া কি দরকার”।

নান্দাইল আচাঁরগাওয়ের সুভন রানী সরকার (৮০) জানান, ”আমার মত হতদরিদ্র নারীদের কেউ খোজখবর নেয় না। নির্বাচন আইলে আমারে জিজ্ঞাসাও করে না ভোট দিতে হইবো কি হইবো না। আমার এত বছর বয়সেও মেম্বার চেয়ারম্যান কোনদিনও আমার কাছে আসেনাই। কোন ভাতা পাইনা, বয়স্ক ভাতার কার্ডের জন্য গেলে কোন কথাই বলে না”। ভোট দিয়া আর লাভকি প্রশ্ন করেন তিনি।

রুবিয়া বেগম নারী কর্মী (৬১) জানান, ৭/৮ বার এমপি (জাতীয় সংসদ) নির্বাচনে ভোট দিয়েছি, কিন্তু আমার ভোটের অধিকার সম্পর্কে আর কেউ কথা বলে না । রুবিয়া আরো বলেন, ভোট দেওয়ার পর আমাদেরকে আলাদা চোঁখে দেখে। আমার এক ভোটের জন্য তো আর জয় বসে থাকে না।

জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত নারী উদ্যোক্তা ও তৃণমৃল কারুপন্যের নির্বাহী পরিচালক আইনুন্নাহার বলেন, কাউন্সিলর বা মেম্বারদের থেকে নারীদের আশানুরূপ সেবা না পাওয়া হতাশার একটি কারণ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ ভোট দিবে কিন্তু নারীদের ভোট দিতে যাওয়াকে নিরুৎসাহী করে। এছাড়াও নারীদের ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবও দায়ী। সমাজের কিছু পুরুষ মানুষ নারীদের ভয়ভীতির কথা বলে কেন্দ্রে না যাওয়ার পরামর্শ দেয়। নারী কোন কাজে ব্যাংক থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ কাজে গেলে পুরুষদের বাধ্যতামুলক উপস্থিতি আর ডকুমেন্ট চাওয়া হয়। এই ক্ষেত্রেও নারীরা নিজেকে গুরুত্বহীন বলে মনে করেন। নারীদের শিক্ষা ও কর্মদক্ষতারও অভাব রয়েছে বলে মনে করেন এই নারী উদ্যোক্তা।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা সেলিমা আজাদ বলেন, দেশের জন্যসংখ্যার অর্ধেকই নারী। তাই নারী ভোটার কম হওয়ার কথা না। তবে আমার দেখা মতে, ভোটার হালনাগাদ করার সময় এক বাড়ীতে বসে অনেক বাড়ীর তথ্য নেওয়া হয়, ফলে নারীরা তাদের তথ্য দিতে আসে না। নারী ভোটার কম হওয়া নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী নেতৃত্বের জন্য আশংকাজনক বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভাপতি মনিরা বেগম অনু বলেন, ’আমার ভোট আমি দিব’ এই ভোট দেওয়ার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে, মুক্তভাবে ভোট প্রয়োগের জায়গাটা আমাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। নারীরা নির্বাচন ও ভোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তারা মনে করে আমার ভোট আমি দিতে পারবো না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন ঈশ্বরগঞ্জের সভাপতি সাইফুল ইসলাম তালুকদার বলেন, নারীরা তাদের কাঙ্খিত ভোট দিতে পারে না, নারীরা ভোটের নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন না। নারীরা শিক্ষা, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হলে ভোটের হার বাড়ানো সম্ভব না। নারীরা সচেতন হলে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলেই নারী ভোটার হতে এবং ভোট দিতে আগ্রহী হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক ইয়াজদানী কোরায়শী কাজল বলেন, নারী বিভিন্ন কারণে ভোটার কম হচ্ছে। ভোট দিতে যাচ্ছে আরো কম। বর্তমান দেশের পরিস্থিতি পরিবেশ বিবেচনা করে তারা ভোটে আগ্রহ হারাচ্ছেন।

সচেতন নাগরিক কমিটি সনাক ময়মনসিংহ মহানগরের সভাপতি শরীফুজ্জামান পরাগ বলেন, গ্রামের বাবা-মায়েরা ছেলেদেরকে যে ভাবে ভোটার হতে উৎসাহিত করেন তেমনভাবে কন্যাদের করেন না। শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে যে অবস্থা নারীদের ভোটের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
সুজন ময়মনসিংহ জেলা সভাপতি নজরুল হায়াত বলেন, নারী পুরুষের বৈষম্য কারণে এটা হতে পারে। রক্ষণশীল পরিবার গুলো তাদের নারীদের ভোট কেন্দ্রে যেতে দিতে আগ্রহী না।
ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের কয়েকজন মহিলা কাউন্সিলর (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান,”আমরা নারীরা তিনটি ওয়ার্ড নিয়ে নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হই। অথচ একজন পুরুষ একটি ওয়ার্ড নিয়ে নির্বাচিত হয়ে তাদের জন্য ওয়ার্ড অফিস বরাদ্ধ, আপ্যায়ন বরাদ্ধ, জনবল থাকে। আর নারীদের জন্য এর উল্টো। জনবলতো নয়ই, নেই কোন বরাদ্ধও। আমরা নারী জনপ্রতিনিধিদের শুধুমাত্র সরকারি ভাতা ছাড়া আর কোন কাজই দেওয়া হয় না। একজন নারী ভোটার নারী জনপ্রতিনিধির কাছে আসে কিছু সুবিধা পাওয়ার আশায়। অথচ আমরা কোন সুবিধাই পাইয়ে দিতে পারি না। এটাও একজন নারীর ভোটারের জন্য হতাশার কারণ”।
ভোট হচ্ছে গনতন্ত্রের অন্যতম প্রধান অংশ। এই ভোটে নারী আগ্রহ হারালে জনমতের ফলাফল আসবে আংশিক। তাই এ দিকে সংশ্লিষ্টদের নজর দেয়া উচিৎ বলে মনে করেন সকলে।

শিল্পী সরকার
ময়মনসিংহ।