পদ্মা সেতু একটি স্বপ্ন-সাহস-আবেগ আর অহমিকা

প্রকাশিত: ১০:১৩ অপরাহ্ণ, জুন ২৮, ২০২২
????????????????????????????????????

মো. আবুল কালাম আজাদ

তুমি অবিচল

দৃঢ় প্রতিজ্ঞ

তুমি ধুমকেতু

বঙ্গবন্ধু দিয়েছে দেশ

তুমি দিলে পদ্মা সেতু।

সত্যিকার অর্থে এই শব্দগুচ্ছ আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ অতঃপর শেখ হাসিনা। বাঙলা এবং বাঙালি জাতিসত্মার ইতিহাসে চিরসত্য শব্দ গাঁথুনি একেবারেই প্রাসঙ্গিক এবং যৌক্তিক। দেশের মানুষকে পদ্মা সেতু উপহার দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিবাদন জানিয়ে এমনই থিম সং নির্মিত হয়েছে।

বাংলাদেশ মাথা নত করেনি। শত বাধা, চাপের মুখে ধীরে কিন্তু দৃঢ়ভাবে এগিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। ‘আমরাও পারি’- আগামীর শক্তি হয়ে ওঠার এ বার্তা বিশ্বকে দিয়ে নিজের টাকায়, মেধায় প্রমত্ত পদ্মায় গর্বের সেতু নির্মাণ করেছে। এমন দিনের জন্যই হয়তো তারুণ্যের কবি, দ্রোহের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘সাবাস, বাংলাদেশ,/ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়ঃ।’ যাঁর সাহসে ‘সম্ভব না’ থেকে সম্ভাবনার পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে ধ্বনিত এ কবিতা প্রতিধ্বনিত হলো পদ্মাপাড় থেকে সারাদেশে এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, আনাচে-কানাচে। পদ্মা সেতুর বহুল প্রতীক্ষার উদ্বোধনে তিনি বললেন, ‘এই জনগণই আমার সাহসের ঠিকানা, এই জনগণকে আমি স্যালুট জানাই।’

দুই যুগের অপেক্ষার অবসান হয় ২৩ জুন ভরদুপুরে। ভরা বর্ষায় পদ্মা যেমন থাকে, সেদিনও তেমনই ছিল। উত্তাল প্রমত্ত। সেই খরস্রোতা নদীর ওপর যে সেতু নির্মাণে ২১ বছর আগে তিনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। টোল দিয়ে সেই তিনিই পদ্মা পার হন প্রথম যাত্রী হিসেবে। বাঙালির অহংকারের সেতুতে দাঁড়িয়ে উতল হাওয়ার বিপরীতে দাঁড়ান গর্ব নিয়ে। যেমন বিরুদ্ধ হাওয়ার বিপরীতে নৌকা বেয়ে এক যুগে তিলে তিলে সত্য করেছেন পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্নকে। বাতাসে এলোমেলো করে দেওয়া কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের চুল সামলে নিতে নিজের মাথার কাঁটা খুলে দেন মায়ের মমতায়। এমনভাবেই এক যুগ ধরে ঝোড়ো হাওয়ায় আগলে রেখেছিলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পকে। যিনি  পঁচাত্তরে মা-বাবা, ভাইসহ পরিবারের প্রায় সবাইকে হারিয়ে ৬ বছর রিফিউজি জীবন কাটিয়ে একাশি সালে দেশে ফেরেন। যে দেশের জনগণই তাঁকে আপন করে নেয়। আর তিনি যখন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন, তখনও জনগণই এগিয়ে আসে; তাঁকে সাহস ও শক্তি জোগায়।

পদ্মা সেতুকে বাংলাদেশের গর্ব, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক আখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, আজ পদ্মার বুকে জ্বলে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি আলোর ঝলকানি। সেতুর ৪১টি স্প্যান যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। আজ বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে এবং ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছি। এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিলের অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। এই সেতু বাংলাদেশের জনগণের। যদিও ষড়যন্ত্রের কারণে সেতু নির্মাণে বিলম্ব হয়েছে বটে; কিন্তু মুজিব কন্যা হতোদ্যম হননি, হতাশায় ভোগেননি। জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সেই অমোঘ মন্ত্র ‘কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না’র পুনরোল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, আমরা বিজয়ী হয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনও মাথা নোয়াননি, তিনি আমাদের মাথা নোয়াতে শেখান নাই, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন।

স্বনামধন্য ব্যক্তি বিশেষের ষড়যন্ত্রে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধে বিশ্বব্যাংকের পদক্ষেপ এবং তাঁকে, তাঁর বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ, ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী এবং মন্ত্রী আবুল হোসেন, উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ও মোশাররফ হোসেনসহ সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দেওয়ার অপচেষ্টাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তা মোকাবিলার ইতিবৃত্ত সুধী সমাবেশে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে যাঁদের চরম মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছিল তাঁদের সহমর্মিতা জানান। ষড়যন্ত্রকারীদের আগামীতে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে, মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল হবে বলেও বঙ্গবন্ধু কন্যা আশা প্রকাশ করেন।

বঙ্গবন্ধুর সেই অমর বাণী- ‘…কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ বাঙালিকে দাবিয়ে যে রাখা যায়নি, তা দেশের দুই প্রান্তকে জোড়া লাগানো পদ্মা সেতুই সাক্ষ্য দিচ্ছে। সেই ইতিহাসের একজন হতে পদ্মার দক্ষিণপাড়ে ছুটে আসেন দেশের নানা প্রান্তের কয়েক লাখ মানুষ। তাঁরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছেন জনসমুদ্রের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা, অসীম দৃঢ় নেতৃত্ব পদ্মা সেতু তৈরি করে তিনি বাংলাদেশের সক্ষমতার গভীরতা বিশ্বকে নতুন করে জানিয়ে দিলেন। পদ্মা সেতুর মত মাস্টার প্রকল্পের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের দীর্ঘ অপেক্ষা শেষ হয়েছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত দেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতু এখন আর কল্পনা নয়, সত্য-বাস্তব। ‘সাবাস, বাংলা দেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়ঃ/জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়…।’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই কথা আবারও শতভাগ পূর্ণতা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও তাঁর বক্তব্যে এ উদাহরণ টেনেছেন। স্বপ্নজয়ের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে- প্রধানমন্ত্রীর অদম্য সাহসিকতা ও অসম্ভব রকমের দৃঢ়তার কারণেই কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু কন্যার বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত, আত্মবিশ্বাস ও দেশপ্রেমই জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, বাধা-বিপত্তি, ঘাত-প্রতিঘাত এবং প্রতিবন্ধকতার ধাপ ডিঙিয়ে যাত্রা শুরু করছে পদ্মা সেতু। এই সেতু শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি এখন বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশের গৌরব, আত্মমর্যাদা, অহংকার ও সক্ষমতার প্রতীক। খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে সেতু হবে- একসময় এ কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। অথচ তখনও স্বপ্ন দেখছিলেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা, বাঙালি জাতির স্বপ্নসারথি। শুধু তাঁর আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা আর ঐকান্তিক চেষ্টায় সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাঙালির স্বপ্ন, সাহস ও অহমিকার পদ্মা সেতু। এটা অবিশ্বাস্য এক রূপকথার বাস্তব প্রতিফলন। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন, সাহস, প্রেরণা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার একটি অসাধারণ স্মারক। এ কারণেই বাঙালি বলতে পারছে- আমার টাকায় আমার সেতু, বাংলাদেশের পদ্মা সেতু।

একশ বছর স্থায়িত্বের গ্যারান্টির পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ঘোষণাক্ষণে শেখ হাসিনা কখনও আবেগে আপ্লুত হয়েছেন, কখনও কেঁদেছেন। আবার তাঁর ৩৪ মিনিটের ভাষণে সবাই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আনন্দিত মুখও। বাংলার মানুষকে যিনি স্বপ্ন দেখান, নিজে স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন- সেই স্বপ্নদর্শী মৃত্যুঞ্জয়ী নেতা শেখ হাসিনার প্রতি মুগ্ধতা বুঝি এ কারণেই ঝরে পড়ে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনক্ষণে আনন্দে শামিল সমবেত অনেকেই বিহ্বল হয়ে বলেছেন, শেখ হাসিনার অদম্য সাহসিকতা ও অসম্ভব রকমের দৃঢ়তার কারণে কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস আর অর্জনের এক অনন্য বার্তাও এই সেতু।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্বনেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। একসময় যারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল তারাই আজ বাংলাদেশের জয়গান গাইছে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাঙলার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সত্যিই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। সকল নেতিবাচকতা আর ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে আড়মোড়া ভেঙ্গে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে সোনালী সম্ভাবনার দিকে, অসীমের পানে। যেখানে নেতৃত্বে রয়েছে জাতির জনকের সুযোগ্য উত্তরসুরী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

মো. আবুল কালাম আজাদ

বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতার্কিক

চেয়ারম্যান

ময়মনসিংহ ডিবেটিং সোসাইটি, ময়মনসিংহ।