মো. আবুল কালাম আজাদ :
দীর্ঘ মেয়াদে সুফল অর্জন করতে চাইলে জাতিকে সুশিতি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যাও। আর সেই সুশিক্ষিত জাতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে স্বশিক্ষিক মানুষ প্রয়োজন। আর সেই স্বশিক্ষিত মানুষই হচ্ছে মানুষ গড়ার কারিগর। তিনিই শিক্ষক। পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে বাতি জ্বালিয়ে মানচিত্রকে আলোকিত করছে যেইজন সেইজন আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রে শিক্ষক খ্যাতি নিয়ে বিচরণ করছে।
এমনই এক নিভৃতচারী মানুষ গড়ার কারিগর মোঃ আব্দুল মমিন। মোহনগঞ্জ উপজেলার এই বাতিঘর শিক্ষকতার মহান পেশা থেকে অবসর নিয়েও যেন তাঁর অবসর নেই। জীবনের শেষ বেলায়ও তিনি বসে নেই, বিরামহীন তাঁর পথচলার এইণে দাঁড়িয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন একটি সুন্দর সমাজের। তিনি স্বপ্ন দেখেন সমাজের প্রতিটি মানুষই সমাজের কল্যাণে নিজেকে নিবেদন করুক। তিনি প্রতিনিয়তই স্বপ্ন দেখেন আলোয় আলোয় ভরে উঠুক চারিপাশ। মানুষ ইতিবাচক চিন্তা আর স্বপ্ন বুনে সমাজকে মানুষের সমাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করুক।
প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে যাওয়া এই বাতিঘর ১৯৫৩ সালে মোহনগঞ্জ উপজেলার পেরীরচর গ্রামে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সাহেদ আলী, মাতা কল্পনেন্নেছা। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। কৈশোর থেকেই তিনি ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তবে কখনোই তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার মনে পোষণ করতেননা।
রামপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে তিনি ১৯৬৮ সালে মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিকে এসএসসি এবং ১৯৭২ সালে নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি‘র পাঠ চুকিয়ে নেত্রকোনা পিটিআই থেকে দুই বছরের প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পাদন করে ১৯৭৪ সালে আটপাড়া উপজেলার বাউসা জুনিয়র স্কুলে সহকারি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতার মহান পেশায় নিজেকে সমর্পণ করেন।
নিরহংকার ও ধর্মানুরাগী জনাব মোঃ আব্দুল মমিন ১৯৭৮ সালে কলমাকান্দা উপজেলার রামনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে পরবর্তীতে মোহনগঞ্জ উপজেলার সুয়াইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গারাউন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আলো বিলিয়ে বেড়িয়েছেন।
১৯৯০ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনি সহিলদেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করে তাঁর নিজেকে শিক্ষকতার মহান পেশায় আরও শানিত করার প্রয়াস চালিয়ে যান অবিরাম। অতঃপর প্রধান শিক্ষক হিসেবে খুরশিমুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাইলোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সফলতার সাথে নিজেকে উপস্থাপন করেন।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই মাইলোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অবসরে চলে যান এই আলোকচ্ছটা। বিধি মোতাবেক সরকারি চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর জনাব মমিন মোহনগঞ্জ আইডিয়াল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর নিজেকে আরেকবার মেলে ধরেন এবং কর্মে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেন।
নিভৃতচারী বাতিঘর জনাব মমিন ১৯৮৮ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক ছেলে ও দুই কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর বড় মেয়ে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অনুরক্ত এই বাতিঘর ২০১১ সালে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন এবং ২০১৯ সালে স্বস্ত্রীক ওমরাহ পালন করেছেন।
বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা প্রশ্নে জনাব মমিন বলেন, সরকার প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে যথেষ্ট আন্তরিক এবং প্রচুর অর্থের যোগান দিচ্ছে বটে কিন্তু সেইদিক থেকে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানের দৃশ্যমান উন্নতি সেইরকম হচ্ছেনা। তবে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, বর্তমান সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন, খাবার পানি, টয়লেট ব্যস্থাপনা উন্নয়নসহ শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে খেলাধুলার উপকরণ সরবরাহ ছাড়াও নানান দিকে যথেষ্ট আন্তরিক।
তিনি বলেন, আগেকার সময়ে কোন কোন বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক দিয়ে চলত বিদ্যালয়ের পাঠদান যা বর্তমানে আশানুরূপ তথা কাক্সিত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এখনকার সময়ে উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে বটে কিন্তু সেইহিসাবে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হচ্ছেনা তথা শিক্ষা কাক্সিত ফল নিশ্চিত হচ্ছেনা বলে এই বিষয়ে কর্তৃপকে আরও আরও সচেতন হতে হবে বলে মনে করেন এই বাতিঘর জনাব মমিন।
জনাব মমিন স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, আমি গর্বিত এইজন্য যে, আমার অগণিত ছাত্র-ছাত্রী সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে অতীব সুনামের সাথে কর্মে নিয়োজিত রয়েছে। তিনি বলেন, আমি যখন শুনতে পাই আমার শিার্থীরা ভাল করছে অথবা তাদের যেকোনো ভাল খবরে আমি অনেক অনেক উচ্ছ্বসিত বোধ করি এবং আমি সকল সময় তাদের কল্যাণের জন্য প্রাণ ভরে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি।
সত্তর ঊর্ধ্ব এই আলোকবর্তিকা জনাব মমিন শিক্ষকতার মহান পেশায় সফলতার স্বীকৃতি স্বরূপ দুইবার নেত্রকোনা জেলায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়ে সরকার থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন। তিনি মোহনগঞ্জ উপজেলার জামেদা বেগম মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এর পক্ষ থেকে ২০১৮ সালে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক পদকে ভূষিত হয়েছেন। তিনি এই পেশায় তাঁর নিজেকে সমর্পণ করে যথেষ্ট সন্তুষ্ট এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেও তিনি সফল এইজন্য যে, তাঁর ছেলে মেয়েরা পড়াশুনার পাশাপাশি মানবিক শিক্ষায় শিক্ষা অর্জন করেছে এবং তাদের ব্যক্তিগত জীবনও আজ সফলতার দেখা পেয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ প্রশ্নে জনাব মমিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি এবং দেশ-মাটি ও মানুষের প্রতি আমাদেরকে আরও আরও আন্তরিক হতে হবে তাহলেই ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্না শান্তি পাবে।
জনাব মমিন দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলেন, নিজেকে এবং নিজের কর্তব্য-কর্ম তথা দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকলে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব।
ব্যক্তিজীবনে নিরহংকারী, প্রচারবিমুখ এবং নিভৃতচারী এই বাতিঘর মোহনগঞ্জ উপজেলার মারকাজ রোডের বাত্তারগাতির নিজ বাসায় সপরিবারে বসবাস করছেন। পরিবারের সাথে সময় ব্যয় করা ছাড়াও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অধিকতর মনোযোগ নিবিষ্ট করেছেন অবসরপ্রাপ্ত এই বাতিঘর। তিনি তাঁর অগণিত ছাত্র ছাত্রীর কাছে তাঁর সুস্থতার জন্য দোয়া চেয়েছেন।