স্টাফ রিপোর্টার :
মলা, ঢেলা মাছের মতোই সবার কাছে সমাদৃত এবং ভিটামিন ‘এ’ খনিজ উপাদান ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসে ভরা সুস্বাদু পিয়ালী মাছ। এটি অন্ধত্ব দূর করে এবং দাঁত ও হাঁড় গঠনে সহয়তা করে। তাই বাড়ন্ত শিশু এবং গর্ভবতী মায়েদের জন্য পিয়ালী মাছ অন্যতম পুষ্ঠিগুণ সমৃদ্ধ খাবার।
পিয়ালী মাছ পদ্মা, যমুনা ও শাখা নদী বিধৌত এলাকায় বসবাসরত মানুষের কাছে অতি পরিচিত। এই মাছের স্বাদ ভোজন রশিক মানুষের মুখে মুখে। একসময় পদ্মা, যমুনা ও শাখা নদী এবং বাঙ্গালী ও আত্রাই নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেতো পিয়ালী মাছ। বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয় ও অতি আহরণের ফলে পিয়ালী মাছ এখন সঙ্কটাপন্ন মাছের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
বিলুপ্তপ্রায় পিয়ালী মাছ রক্ষার্থে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বগুড়া জেলার সান্তাহার প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণা পরিচালনা করে দেশে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়। ফলে পিয়ালী মাছের পোনা প্রাপ্তি এখন সহজতর হবে এবং মাঠ পর্যায়ে চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, করোনা সংক্রমনের মধ্যেই এক মাসের ব্যবধানে দেশীয় ছোট মাছ ঢেলা ও বাতাসির পর এবার পিয়ালী মাছের পোনা উৎপাদন ইনস্টিটিউটের গবেষকদের জন্য এটা বিরাট সাফল্য। ইনস্টিটিউটের গবেষনায় এ পর্যন্ত পাবদা, গুলশা, টেংরা, বাটা, ফলি, মহাশোল, খলিশা, বৈরালী, জাতপুটি, গজার, আঙ্গুস, খলিসা, মেনি, বালাচাটা, দাতিনা, গুতুম, ঢেলা, বাতাসী ও পিয়ালীসহ বিলুপ্তপ্রায় ২৯ টি প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
পিয়ালী মাছের গবেষক দলে ছিলেন উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ডেভিট রিন্টু দাস, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো: মনিরুজ্জামান ও মালিহা খানম। তিনি জানান, পিয়ালী মাছ এলাকাভেদে জয়া, পিয়ালী বা পিয়াসী নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Aspidoparia jaya।
এ মাছটি সিপ্রিনিডি (Cyprinidae) পরিবারভূক্ত মিঠা পানির একটি মাছ। বাংলাদেশের পদ্মা ও যমুনা এবং তাদের শাখা নদীতে, ভারতের আসাম, উত্তরাঞ্চল ও উত্তর প্রদেশ, নেপাল, ইরান, মায়ানমার, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও আফগানিস্থানে এই মাছের বিস্তৃতি রয়েছে।
পিয়ালী মাছ দৈর্ঘ্যে ৫ থেকে ১৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর দেহ লম্বা ও পার্শ্বীয়ভাবে চাপা। পরিপক্ক পুরুষ মাছের পেট হলুদাভ থাকে ও স্ত্রী মাছের চেয়ে আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হয়। স্ত্রী মাছের পেট ধবধবে সাদা ও হালকা স্ফীতাকার হয়ে থাকে। এ মাছের একটা বৈশিষ্ট্য হলো- প্রতিবছর পিয়ালী মাছের শরীরের আঁইশ ঝড়ে পড়ে এবং নতুন আঁইশ তৈরি হয়। সুস্বাদু পিয়ালী মাছ এখন বাংলাদেশের সঙ্কটাপন্ন মাছের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে।
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধিনে বগুড়া জেলার সান্তাহারস্থ প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের গবেষকরা যমুনা, বাঙ্গালী ও আত্রাই নদীসহ বিভিন্ন উৎস থেকে পিয়ালী মাছের পোনা সংগ্রহ করে উপকেন্দ্রের পুকুরে নিবিড়ভাবে প্রতিপালন করেন। গবেষকরা পিয়ালী মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করেন। প্রাকৃতিক জলাশয়ে পিয়ালী মাছ মূলত; প্লাংকটন (শ্যাওলা) ভোজী।
গবেষণাকালে একটি ৬ গ্রাম ওজনের পিয়ালী মাছ বিশ্লেষণ করে এর পেটে ৮০.৭১% ফাইটোপ্লাংটন এবং ১৯.২৯% জুপ্লাংটন পাওয়া যায়। তাছাড়া বছরব্যাপী জিএসআই ও হিস্টোলজি পরীক্ষণের মাধ্যমে পিয়ালী মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করা হয়। এ প্রজাতির মাছ সাধারণত বর্ষাকালে অগভীর জলাশয়ে প্রজননে অংশগ্রহণ করে থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মে থেকে আগস্ট এবং ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে নদীতে প্রজননক্ষম পরিপক্ক স্ত্রী মাছ পাওয়া যায় এবং জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে জলাশয়ে পিয়ালীর পোনার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এতে প্রমাণিত হয় পিয়ালী মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মে-আগস্ট এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারি। পিয়ালী মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা আকার ভেদে ১৫০০-৩৫০০ টি।
গবেষণায় আরো দেখা যায়, একটি পরিপক্ক স্ত্রী পিয়ালী মাছ ৩.৫-৬ গ্রাম ওজনের হলেই প্রজনন উপযোগী হয়। প্রজনন উপযোগী পুরুষ পিয়ালী মাছ আকারে অপেক্ষাকৃত বড় (৪-৬ গ্রাম) হয়। ইনস্টিটিউটের চলমান এই গবেষণায় ৫ জোড়া পিয়ালী মাছকে চলতি জুন মাসে ১:১.৫ অনুপাতে হরমোন প্রয়োগ করা হয়। হরমোন প্রয়োগের ৬-৮ ঘন্টা পর ডিম ছাড়ে এবং ২০-২২ ঘন্টা পরে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু পোনা উৎপাদিত হয়। ডিম নিষিক্ততার পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৬ ভাগ। উৎপাদিত রেণু বর্তমানে ইনস্টিটিউটের প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের হ্যাচারিতে প্রতিপালন করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও গবেষক দলের প্রধান ড. ডেভিড রিন্টু দাস জানান, পিয়ালী মাছ দ্রুত বর্ধনশীল ও খেতে খুবই সুস্বাদু। এই মাছ আমিষ, চর্বি, ক্যালসিয়াম এবং লৌহ সমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম পিয়ালী মাছে মেথিয়োনিন ৭৫০ মিলিগ্রাম, সিস্টিন ৪২০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৪৩০ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৬৭০ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ১৫০ মিলিগ্রাম, জিঙ্ক ১২.৮ মিলিগ্রাম, আয়রন ২৫ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ৮.২১ মিলিগ্রাম এবং ১.৪০ শতাংশ কপার রয়েছে যা অন্যান্য অনেক দেশীয় ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি। ক্যালসিয়ামের অভাব পূরণে এই মাছ অত্যন্ত কার্যকরী।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ আরো জানান, দেশীয় মাছ রক্ষার্থে ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম করোনা সংক্রমণের মধ্যেও জোরদার করা হয়েছে। সকল দেশীয় মাছকে সুরক্ষা এবং জীববৈচিত্র সংরক্ষণসহ দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়াই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। চলতি বছর ১০টি দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছিল। যা ছিল ইনস্টিটিউটের জন্য একটা বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ। আশার কথা হলো, ইতোমধ্যে ঢেলা, বাতাসী, লইট্যা ট্যাংরা, পুইয়া ও পিয়ালী মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। শিগগিরই আরো দু’টি দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদনের সাফল্যের খবর আসছে। দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির সকল ছোট মাছ গবেষনার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ভোক্তাদের খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
সূত্রমতে, আইইউসিএন বাংলাদেশ (২০১৫) এর হিসেব মতে দেশের ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশ অর্থাৎ ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। এরমধ্যে ৯টি (৩%) অতি বিপন্ন, ৩০টি (১২%) বিপন্ন ও ২৫টি (১০%) শঙ্কাগ্রস্থ পর্যায়ে অন্তর্ভূক্ত। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় ইতোমধ্যে পিয়ালীসহ ২৯ প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করতে সম্ভব হয়েছে।
এরমধ্যে পাবদা, গুলশা, টেংরা, বাটা, ফলি, মহাশোল, খলিশা, বৈরালী, ঢেলা, বাতাসী, ইত্যাদি অন্যতম। ফলে এসব মাছের প্রাপ্যতা সাম্প্রতিককালে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মূল্যও সাধারণ ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে এসেছে। ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে গতে ১২ বছরে চাষের মাধ্যমে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ।
দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহস্থ স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে একটি ‘লাইভ জীন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ এবং পোনা উৎপাদনে গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২০ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করে বলেও জানান তিনি।