পৃথিবীর বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাচ্ছে আমাদের সামনে। আমাদের দেশে বর্তমানে সর্বক্ষেত্রেই উন্নত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের শেষ পর্যন্ত কোন দিগন্তে নিয়ে যাবে সেটা ধারণারও অতীত। এক-পা, দু’-পা করে আমরা সভ্যতার একেকটি স্তর অতিক্রম করছি। সভ্যতার উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির অবদান অপূরণীয়। বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির কথাটি খুব উচ্চস্বরে বলাও হয়ে থাকে।
কিন্তু মুখভরা অভিব্যক্তি নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির অবদানের কথা বিভিন্ন জায়গায় তুলে ধরা হলেও উন্নত এ প্রযুক্তির বাছবিচারহীন ব্যবহার যে আমাদের সমাজের জন্য কত বড় অন্ধকার নিয়ে আসছে সে দিকটার প্রতি সহসা কারো নজর যেতে চায় না। দেশের বিরাট এক জনগোষ্ঠী আজকাল ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তির আসক্তির মধ্যে রয়েছে। প্রযুক্তি আমাদের নতুন নতুন অনেক কিছু দিচ্ছে, অনেক কিছু শেখাচ্ছে সত্যি, পাশাপাশি আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়েও নিচ্ছে।
দেশে অব্যাহতভাবে নির্বিচারে চলছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার। বিশেষ করে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, টুইটার, ভাইবার, হোয়াটস-অ্যাপ, গেইমস এবং স্যাটেলাইট চ্যানেলের অপব্যবহার। এ ছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর অন্যান্য মাধ্যমের ভয়ানক আগ্রাসন তো আছেই। ফলে দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতায় ব্যাপক ইতিবাচক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি যথেষ্ট নেতিবাচক পরিবর্তনও এসেছে। আর এর মূল ভুক্তভোগী হচ্ছে শিশু-কিশোররা। আমরা কি কখনও অনুধাবন করে দেখেছি, তথ্যপ্রযুক্তির অকল্যাণকর দিকগুলো আমাদের আগামী প্রজন্মের অবস্থান কোথায় নামিয়ে দিচ্ছে? তথ্যপ্রযুক্তির হাওয়া লেগেছে সর্বত্র; কিন্তু সেটি হজমের শক্তি আছে কি প্রজন্মের?
নৈতিকতা। মূল্যবোধ। দেশপ্রেম। জাতিগঠন। এ কথাগুলো আমরা হরহামেশাই বলে থাকি। নতুন করে এর ব্যাখ্যা হাজির করার কোনো অবকাশ নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে শিশু-কিশোরদের কিছু ঘটনায় এ বিষয়গুলো নিয়ে আবারও নতুন করে কিছু বলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং এগুলো পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ঘটনাগুলো যে কোনো বিবেকবান ও সচেতন মানুষকে ভাবিয়ে তোলবে। শিশু-কিশোররাই যখন দেশ তথা জাতির শক্তি, দেশের উন্নয়নের কৃতী অংশীদার তখন তাদের বাদ দিয়ে তো কিছু চিন্তা করা যায় না- সেটি পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক। তবে দুঃখের কথা হলো, আমাদের দেশের শিশু-কিশোররা আজ নানাভাবে বিপথগামী হচ্ছে। প্রতিদিনই শিশু-কিশোররা নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হয়ে ওঠছে। ডিজিটাল গেইমস, মাদক, সন্ত্রাস, পর্নোগ্রাফি, ধর্ষণ ও জঙ্গিবাদী কর্মকান্ডের মতো নানা অপকর্মের দিকে তারা প্রতিনিয়তই পা বাড়াচ্ছে।
ক্রমেই আলাদা হওয়ার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এ সমাজে। সেখানে পারিবারিক বন্ধনগুলো দূর্বল হচ্ছে, নিজেদের ভেতরের ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক হচ্ছে নষ্ট, শিথিল হচ্ছে সামাজিক বন্ধন। ছোটদের চক্ষুলজ্জা কমে যাচ্ছে। বড়দের কেউ সম্মান করছে না। সবাই নিজেদের মতো করে চলছে। আলাদা হয়ে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থতার দিকে ঝুঁকছে সবাই। আগামী প্রজন্মের দিকে কেউ তেমন নজর দিচ্ছে না। সবকিছু পেরিয়ে নিজের প্রসিদ্ধি ও নিজের উন্নতিই যেন এখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উন্মুক্ত সাইবার সংস্কৃতির কু-প্রভাবে আক্রান্ত হয়ে অনেক শিশু-কিশোর বিদ্যালয় থেকে প্রতিনিয়ত ঝরে পড়ছে এবং বিপথগামী হচ্ছে। এই ভয়ংকর অশ্লীলতা ও পর্নোগ্রাফি শিশুদের মাঝে বিস্তৃত হওয়ার অন্যতম একটি মাধ্যম হলো মোবাইল ফোন বা স্মার্ট ফোন। এখন দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট শিার্থীদের হাতেও মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, মাল্টিমিডিয়া, ডিজিটাল গেইমস কিংবা গোপন ভিডিও’র প্রতি স্কুল পর্যায়ের শিশুরা অত্যধিক ঝুঁকে আছে। আর এগুলোর মাধ্যমে অশ্লীল ও পর্নোছবি দেখে আমাদের নিষ্পাপ সন্তানেরা হারাচ্ছে নৈতিক, মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ, বাড়ছে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ, তৈরি করছে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অশ্রদ্ধা- বিশেষ করে নারীদের প্রতি। শিখছে অশ্রাব্য ভাষা ও কু-ইঙ্গিত করার কৌশল। শিখছে বাবা-মা এবং বড়দের অসম্মান করা। তাছাড়া অনেকে নিজেকে ছবির হিরো মনে করে ছবির বিষয়বস্তুকে নিজ জীবনে বাস্তবায়ন বা অনুকরণ করার চেষ্টা করছে। যার ফলে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব আমরা প্রায়শই ল করছি। এ ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক অপরাধগুলোর অধিকাংশই সংঘটিত হচ্ছে টিন এজারদের মাধ্যমে।
দেশের প্রায় সব উপজেলায় বিভিন্ন বাজার, রাস্তার মোড়, খেয়াঘাট, বিশেষ করে যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মানুষের আনাগোনা একটু বেশি সেখানে গড়ে উঠেছে স্থায়ীভাবে বা ভাসমান ডিজিটাল টি-স্টল (!), কেউ কেউ একে আবার মিনি সিনেমা হল (!) বলেও অভিহিত করেন। আর এগুলোতে ব্যবসাও হচ্ছে জমজমাট। এসব প্রত্যেক দোকানে চা বিক্রির জন্য দোকানির মূল পুঁজি হলো একটি রঙিন টিভি আর সিডি। বর্তমানে গ্রামের অনেক বাজারে স্যাটেলাইট সংযোগও চালু আছে। তাদের মূল টার্গেট এক সময়ের ভিসিআর দর্শক, পথচারী, স্থানীয় বাসিন্দা, অটোচালক, ভ্যানচালক আর পাশাপাশি বিদ্যালয়গামী কোমলমতি শিশুরা। মোড়ে মোড়ে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এই চায়ের দোকানগুলোতে চলে বিভিন্ন অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ছবি। আর প্রত্যেক টি-স্টলে টিভির দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। ভীড় বাড়লেই বেচাকেনা বাড়বে তাই দোকনদাররা কিছুই বলছে না এই শিশুদের। ফলে আমাদের গ্রামাঞ্চলের অনেক অবুঝ শিশু আস্তে আস্তে বিদ্যালয়বিমুখ হয়ে পড়ছে এবং একসময় বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। কোমলমতি শিশুদের যখন স্কুলে থাকার কথা তখন তারা দেখছে অশ্লীলতা আর মারামারির দৃশ্য সংবলিত সিনেমা। অনেক শিশু রাতের বেলাও দেখছে সিনেমা। এতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া বিস্মৃত হওয়ার পাশাপাশি তারা বিপথগামীও হচ্ছে। তারা টি-স্টলে বড়দের সাথে বসে এইসব অশ্লীল ছবি দেখছে এবং বড়দের মুখে আজে-বাজে মন্তব্য শুনছে ও শিখছে।
অসৎ বন্ধুর পাল্লায় পড়ে, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারে এবং উন্মুক্ত সাইবার সংস্কৃতি কু-প্রভাবে অনেক কিশোর-কিশোরী মাদকে নিমজ্জিত হচ্ছে। স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষার্থীর মাদকের নেশায় কাটছে দিন। অনেক মা-বাবা বুঝতে পারেন সন্তানের ভেতর পরিবর্তন, কিন্তু তাদের যেন করার কিছু নেই। চলাফেরা, আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তনের লক্ষণ! রাত জাগা, মিথ্যা বলা, স্কুল-কলেজে না যাওয়া, প্রাইভেটের নামে অন্যত্র যাওয়া, বিভিন্ন অজুহাতে টাকা চাওয়া। এমনকি তার শখের মোবাইলটি তার হাতেও একদিন দেখা যায় না। নেশার খরচ মেটাতে মোবাইল ফোনটিও বিক্রি করে দেয়।
মাদকাসক্তরা পিত-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত জনদের কাছে নেশার টাকার জন্য মিথ্যাচার ও ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়। এমনকি নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য ঘর হতে টাকা চুরি করা, ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করা, রক্ত বিক্রি করা, দেহব্যবসা করা ও খুন করার মতো কাজেও তারা জড়িয়ে পড়ে।
কিশোর-কিশোরীদের একটা গ্যাং তৈরি হয়েছে এখন প্রতি শহরে। ম্যাসেঞ্জারে ওদের দৈনন্দিন কথা চলে মিনিটের পর মিনিট। গ্যাংরা যত দূরেই থাকুক, ইন্টারনেট এখন সব দূরত্ব ওদের থেকে কেড়ে নিয়েছে। তাই অপরাধীরা ইন্টারনেটের সুবাদে যে কোনো প্রান্তে বসেই তাদের কাজগুলো সেরে নিচ্ছে অনায়াসে। ওদের হাতে বিশে^র আজেবাজে খবরাখবরগুলো আসে সবার আগে। বিশেষ করে পশ্চিমা-সংস্কৃতি ও নোংরা ভিডিও থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ওদের মনন-মগজে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে, ওসবই এখন তাদের ধ্যান-জ্ঞান-নেশা। তাদের এগুলো জানা যেন একটা অবশ্যিক ফ্যাশন। অবাধ ইন্টারনেটের সুবাদে মাদক, ইভটিজিং, চাঁদাবাজি ও জঙ্গিবাদের মতো অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে অনেক কিশোর।
শিশু-কিশোরদের ভয়ানক এই ডিজিটাল প্রোগ্রাম-আসক্তির পিছনে বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। অনেকে সাধারণত ফ্যাশন হিসেবে বা অবসর সময় কাটানোর জন্য প্রথমে বিভিন্ন প্রোগ্রামমুখী হয়। অনেকে আবার বিভিন্ন ধরনের গেইম খেলার মাধ্যমেও দিনে দিনে আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে অনলাইন কাসের নামে শিশু-কিশোরদের হাতে মোবাইল ও ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় তারা এগুলোর অপব্যবহার করছে। এ ছাড়াও সুষ্ঠু বিনোদনের অভাব, দলগত চাপ বা সঙ্গী-সাথীদের প্রভাব ও প্রলোভনে অনেক শিশু-কিশোর বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। প্রয়োজনীয় মাঠ-পার্কের অভাব, খেলাধুলার প্রতি অনীহা, অভিভাবকদের উদাসীনতা, অবহেলা, অতিশাসন কিংবা অতি আদর এর কারণ হতে পারে।
পরিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অবিশ্বাস, অশান্তি, পরিবারে অপসংস্কৃতির চর্চা, অভিভাবকের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন, পারিবারিক বিচ্ছেদ, বিবাহ বিচ্ছেদ, বহু বিবাহ এবং পরকীয়ার মতো বিষয়গুলোও হতে পারে সন্তানের বিপথগামীতার জন্য দায়ী। সামাজিকরণের মাধ্যমসমূহ প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া, অসামাজিকতা, মানসিক বৈকল্য, যৌথ-পরিবার বিলুপ্তি, জীবনে প্রকৃত ধর্মচর্চার অভাব, বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সুশিক্ষার অভাব, আদব-কায়দা শিক্ষার অভাব, বিচারহীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলোও সন্তানদের নেতিবাচক ডিজিটাল আসক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ নয় বরং তথ্যপ্রযুক্তি কী, এটা কেন ব্যবহার করা উচিত তা সন্তানদের বুঝিয়ে দিতে হবে। সন্তানের কাছে প্রযুক্তির ভাল ও ক্ষতিকর দিক তুলে ধরতে হবে, কতটুকু ব্যবহার করা উচিত সে বিষয়ে ধারণা দিতে হবে। দরজাবদ্ধ একটা রুম স্থায়ীভাবে সন্তানকে বরাদ্দ দেয়া যাবে না। নিয়মিত সন্তানের খোঁজ-খবর রাখতে হবে, সন্তান যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী করা, কাজের ফাঁকে সন্তানদের সময় দেয়া, ছুটির দিনে পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে একসাথে খাওয়া ও বেড়াতে যাওয়া, মাঝে মাঝে সন্তানদের নিয়ে ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানসমূহে বেড়াতে যাওয়া, পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে দেয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের পাঠাগারগুলো সমৃদ্ধ করা, বাড়িতে ব্যক্তিগত পাঠাগার গড়ে তোলা, বাড়িতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-সহ সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করা জরুরি। ফাঁকে ফাঁকে সময়-সুযোগ বুঝে তথ্যপ্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে সন্তানদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে সন্তান যেন খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশতে না পারে।
নিজেরা সংযত জীবনযাপন করতে হবে এবং সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই সংযত জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। পরিবারে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশীলনের বিকাশ ঘটানো দরকার। মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাই শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, পারে জঙ্গিবাদ থেকে দূরে রাখতে।
শিক্ষাকে বাস্তব ও জীবনমুখী করতে হলে শিক্ষাক্রমকে বিস্তৃত করতে হবে, শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে- নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যক্তি ও সমাজকে সুস্থভাবে গড়ে তুলতে হলে নৈতিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নাই। শিক্ষা যেন শিশুর নিকট বোঝা না হয়ে আনন্দদায়ক হয়। গুরুত্ব দিতে হবে দেশপ্রেমের প্রতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে মূল শিক্ষাক্রমের পাশপাশি নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলীও পরিচালনা করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় সপ্তাহে অন্তত একটি নৈতিকতা শিক্ষার কাস সব শ্রেণিতে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। এই কাসে শিক্ষকেরা গুরুজনকে শ্রদ্ধা করা, ছোটদের স্নেহ করার বিষয়ে শেখাবেন; জানাবেন মাদকের ভয়াবহতার কথা, জঙ্গিবাদের কুফলের কথা, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা।
অযথা সন্তানদের স্মার্টফোন দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বর্তমান করোনাকালে অনেক শিশু-কিশোর অনলাইন কাসের নামে স্মার্টফোনের অপব্যবহার করছে, তারা বিভিন্ন ক্ষতিকর গেইমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে; জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে পড়াশোনার সাথে সম্পৃক্ত অ্যাপস বা প্রয়োজনীয় সাইডগুলো ছাড়া অন্য কোনো সাইডে যেন প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়টি অভিভাবকদের কড়া নজরদারিতে রাখতে হবে। সাংস্কৃতিক প্রবাহকে ইতিবাচক ধারায় সঞ্চারিত করে দিতে হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে গেলে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার লালন, পালন ও কর্ষণ করতে হবে। সত্য কথা বলা, মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকা, কারো ক্ষতি না করা, কপটতা ও প্রতারণা পরিহার করা, কাউকে অসম্মান না করা, বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করা ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলীগুলো ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের চর্চা করা শেখাতে হবে। সন্তানদেরও পিতা-মাতার কথা শুনতে ও মানতে হবে। আবার সন্তানকে অতিরিক্ত বা লাগামহীন শাসন করা থেকেও বিরত থাকতে হবে।
আমাদের দেশে পর্নোগ্রাফি বন্ধ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার কঠোর আইন করেছে। পর্নোগ্রাফি আইনে পর্নোগ্রাফি তৈরি, বিতরণ, বিক্রি এবং ব্যবহারের আলাদা আলাদা শাস্তির বিধান রয়েছে। সর্বনিন্ম শাস্তি দুই বছর এবং সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদ- ও এর সাথে আর্থিক জরিমানার বিধানও রয়েছে।
পাশাপাশি পর্নোগ্রাফি উৎপাদনের সরঞ্জাম, প্রচার-সরঞ্জাম বা মাধ্যম জব্দ করার বিধানও আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বহন-পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯০’ মোতাবেক নিষিদ্ধ ও দ-নীয় অপরাধ। মাদক-অপরাধের শাস্তি ছয় মাসের কারাদ- থেকে সর্বোচ্চ মৃত্যুদ- পর্যন্ত হতে পারে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- করে নতুন করে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও এ ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।
আসলে শুধু আইন করে বা অধ্যাদেশ জারি করে এ ধরনের অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষা, নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা, মূল্যবোধ ও চরিত্র-গঠন, শক্তিশালী পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সচেতনতা, দেশপ্রেম ও সামাজিক আন্দোলন। অভিভাবকদের সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলতে হবে। অন্যায় করলেও তাদের দূরে সরিয়ে দেয়া যাবে না। সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে এ বিষয়ে আরো কঠোর ও আন্তরিক হতে হবে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচার, পর্নোগ্রাফি, ডিজিটাল প্রযুক্তির নানারকম বাজে প্রোগ্রাম শিশু-কিশোরদের মনোজগতকে গ্রাস করার প্রয়াস পাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই এগুলোর প্রচার ও প্রসার সেন্সর করা উচিত। বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সকল অশুভ শক্তিকে হার্ডলাইনে ও অনলাইনে। তাহলে আমরা পারবো আমাদের অমিত সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যতের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলতে এবং তাদের নিয়ে গর্ব করতে। তারাও পারবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। এ জন্য পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র সকলকে যার যার অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই- বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সঠিক ও উপযুক্ত ব্যবহারই পারে আমাদের একটি সুন্দর সমাজ উপহার দিতে। মনে রাখতে হবে সমাজ যদি সুস্থ থাকে তবেই না প্রগতি ও প্রযুক্তি। অসুস্থ-মৃতপ্রায় সমাজে গ্রগতি ও প্রযুক্তি কোনো কাজে আসবে না।
লেখক:
শরীফুল্লাহ মুক্তি
কলাম লেখক, শিক্ষা-গবেষক ও ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি), নান্দাইল, ময়মনসিংহ।
ই-মেইল-ahmsharifullah@yahoo.com