গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি :
চারদিকে সবুজের বেস্টনীতে মাঝে ভাসছে জলজ দ্বীপ; সেখানে শুধু পানি থইথই করছে। আর সেই পানিতে ভাসছে শসা আর শসা! এমন দৃশ্য কল্পনা জগতের বা বিদেশের নয়; এমন অপরূপ সাজে সেজেছে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার নন্দীগ্রাম। জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে কৃষকের অসাধারণ সাফল্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। বিষমুক্ত শসা চাষে এগিয়ে এসেছেন হাজারো কৃষক। দেশজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ অঞ্চলের ‘বিষমুক্ত শসা’।
উপজেলা কৃষি অফিসার লুৎফুন্নাহার বলেন, চলতি মৌসুমে ২৫ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভিত্তিতে শসা চাষ হচ্ছে। এতে প্রায় ৩শ কৃষক নিয়োজিত আছেন। প্রত্যেককে কৃষককে কৃষি বিভাগ থেকে নিয়মিত পরামর্শ ও কারিগরী সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।
রাসায়নিক বিষ মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং উচ্চমূল্য তাই বিষমুক্ত শসা চাষ করেন উপজেলার নন্দীগ্রামের কৃষক আবু নাসের সোহেল। তিনি ডা. আব্দুল গফুরের পুত্র। দুই একর পুকুরের পাড়ে শসা চাষ করেছেন। তার বয়স ৩৫বছর। তিনি চাকুরীর পিছনে ছুটে বেড়াননি। নিজের সাফল্য হাতের মুঠে টেনে এনেছেন। শসা চাষে তিনি কোনো ক্ষতিকারক বিষ প্রয়োগ না করায় এলাকায় মডেল কৃষকের পেয়েছেন স্বীকৃতি। পোকামাকড় ও রোগবালাই থেকে ফসল বাঁচাতে ব্যবহার করেছেন জৈব বালাইনাশক। তিনি জানান, তার পুকুরপাড়ে শসা চাষে খরচ হয়েছে প্রায় ৫০হাজার টাকা। ইতোমধ্যে ১লাখ ২৩হাজার টাকার শসা বিক্রি করেছেন। আরো লাখ টাকার শসা বিক্রি হবে। তিনি আরো জানান, পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি পুকুরের পাড় এখন বিশাল অর্থকরী হয়ে উঠেছে। এক সময় এসব পাড় পরিত্যক্ত থাকতো। এখন সামান্য পরিশ্রমেই মিলছে অধিক ফসল। এ প্রসঙ্গে কলতাপাড়া ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার সুমন চন্দ্র সরকার জানান, কৃষকের নিকট জৈব বালাইনাশক ব্যবহার উৎসাহিত করা হচ্ছে। কৃষকও রাসানিক বিষমুক্ত সবজি চাষে আগ্রহী। তিনি আরো জানান, কলতাপাড়া ব্লকের ৮টি গ্রামে অর্ধশত কৃষক বিষমুক্ত শসা চাষ করে আসছেন। এসব শসা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। উপজেলার কলতাপাড়া, রামগোপালপুর ও পূর্বদাপুনিয়ায় গড়ে উঠেছে অস্থায়ী শসা বাজার।
অপরদিকে গৌরীপুর-রামগোপালপুর সড়কের ভবানীপুর গ্রাম। অকান্ত পরিশ্রমী ভূমিহীন কৃষক নুরুল হক ‘স্বল্প জমিতে অল্প টাকায়- শসা চাষে পেয়েছেন দ্বিগুণ লাভ’। অসাধারণ সাফল্যের জন্য তিনিও আজ মডেল কৃষক। তিনি উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের ছাবেদ আলীর পুত্র। বাড়িতে শুধুমাত্র মাথা গোঁজার রয়েছে ৬শতাংশ জমি। অন্যের জমি চাষ করেন। এবছর প্রতিবেশী আজিজুল হকের পুকুরপাড়ে চুক্তিভিত্তিক মেয়াদে ভাড়ায় নেন ৬০শতাংশ জমির পুকুরের পাড়। শসা চাষে প্রায় ৫২হাজার টাকা খরচ হয়। ইতোমধ্যে খরচের টাকা উঠে গেছে। আরো ৪০হাজার টাকার শসা বিক্রি সম্ভব। এছাড়াও রাস্তাধারে জয়নাল আবেদিন ম্যানেজার, আব্দুল জব্বার ও মোঃ আশিক মিয়া পুকুর পাড় হলেও সেখানে বিনাভাড়ায় শসা চাষের সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
বিষমুক্ত শসা চাষের বার্তা ছড়িয়ে যাচ্ছে উপজেলার সর্বত্র। পুকুরপাড়ে ও রাস্তার ধারে সবজি উৎপাদনে উপজেলায় বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রায় ৫শ কৃষক জীবিকানির্বাহ করছেন। তাদের কাছে ‘স্বল্প জমিতে অল্প টাকায়-দ্বিগুণ লাভের’ স্থান হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে পুকুরপাড়। কৃষাণী জাহেরা খাতুন জানান, আমাদের কিছুই নেই, শ্রমই একমাত্র পুঁজি। রামগোপালপুর ইউনিয়নের মোঃ শাহজাহান জানান, রাস্তাধারে বা পুকুরপাড়ে সবজি উৎপাদন করলে বর্ষা মৌসুমে ক্ষতি কম হয়। পুকুরের পাড়ে মাটির পুষ্টিগুণ বেশি থাকায় ফলনও ভালো হয়।
পশ্চিমপাড়া গ্রামের কৃষক আবুল হাসিম জানান, ফসল উৎপাদন হয় না পরিত্যক্ত এসব জমির স্থানীয় নাম ‘বাইঞ্জা’। নুরুল হক পরিশ্রম-এ অঞ্চলে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
শতশত কৃষকের পরিশ্রমে পানির মাঝেই জন্ম নিয়েছে সবুজের ভান্ডার, ভাসছে শসা! উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ লুৎফুন্নাহার জানান, এ পদ্ধতি এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার শতাধিক কৃষক পুকুরপাড় ও রাস্তার ধারে শসা উৎপাদন করছে।