টুঙ্গিপাড়ার যুবক শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন থেকে রাজনীতি শুরু করেন সেদিন থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মোচন হয়েছিল এবং উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের চিন্তা। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উক্তি ‘আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণ কর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দরিদ্র লাঞ্চিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকবো, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শুনাবে, এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই।’ যদিও রবীন্দ্রনাথ এই উক্তিটি করেছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের ভারত সম্রাজ্য ত্যাগের উদ্দেশ্যে কিন্তু তাঁর এই উক্তিটি একেবারে মিলে গেল বাঙলার মাটি থেকে পাকিস্তানিদের দেশ ত্যাগের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় পূর্ব দিগন্তের সেই মহান পুরুষ আর কেউ নয়-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীন বাংলাদেশ-একটি লাল সবুজ মানচিত্র। শুধুমাত্র পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের নয়। হাজার বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ফসল এই স্বাধীন বাংলাদেশ। শতবছর আগে মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম সহ জানা অজানা শত সহস্র মানুষ আত্মহুতি দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপন করে গেছেন। বাঙালির জন্য এই স্বাধীন ভূখন্ড প্রতিষ্ঠার জন্য শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন সোহরাওয়ার্দি, মাওলানা ভাসানীসহ আরও অনেক নেতা শত শত বছরের মুক্তি সংগ্রামে বিভিন্নভাবে তাদের অবদান রেখে গেছেন। সর্বশেষ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ শব্দগুলো ওতপ্রোত জড়িত এই কারণে যে, বঙ্গবন্ধুই বাঙ্গালিদেরকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাঁকে বাংলাদেশের স্থপতি বলা হয়। কারণ বঙ্গবন্ধুর মত আর কেউ কখনো এমন করে ভাবতে পারেনি যে বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রয়োজন। বাঙ্গালিদের জন্য একটি আলাদা আবাসভূমি হবে। সেখানকার মানুষগুলি হবে অসাম্প্রদায়িক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি ও কল্যাণে নির্মিত হবে একটি উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও চেতনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই চিন্তা হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নাই। কলকাতার সাহিত্যিক অন্নদা শংকর রায় বঙ্গবন্ধুকে একবার প্রশ্ন করেছিলেন ‘শেখ সাহেব, বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘সেই ১৯৪৭ সাল। আমি সোহরাওয়ার্দি সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎবসু (নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসুর ভাই) চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ। বাঙ্গালিরা এক হলে কি না করতে পারত। তারা জগৎ জয় করতে পারত। দিল্লী থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন শেখ সাহেব। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কেউ রাজি না তাদের প্রস্তাবে। তারা হাল ছেড়ে দেয়। আমিও দেখি যে আর কোন উপায় নাই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে আরম্ভ করি। তখনকার মত পাকিস্তান মেনেই নিই। কিন্তু আমার স্বপ্ন সোনার বাঙলা। সেই স্বপ্ন কেমন করে পূর্ণ হবে এই আমার চিন্তা। হবার কোন সম্ভাবনাও ছিলনা। লোকগুলো কমিউওনাল! বাংলাদেশ বললে সন্দেহ করত। হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাঙলা ভাষা। আমি ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। ভাষা ভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দেই দেশ ভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন একদিন আসে আমি আমার দলের লোকদের জিজ্ঞাসা করি। আমাদের দেশের নাম কি হবে? কেউ বলে পাক বাঙলা, কেউ বলে পূর্ব বাঙলা। আমি বলি না – বাংলাদেশ। তারপর আমি স্লোগান দেই জয়বাংলা। ওরা তখন বিদ্রুপ করে বলে জয়বাংলা না জয় মা কালি। কি অপমান। সে অপমান সেদিন আমি হজম করি। আসলে ওরা আমাকে বুঝতে পারেনি। জয় বাঙলা বলতে আমি বুঝাতে চেয়েছিলুম বাঙলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয় যা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে।’
বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ এই বিষয়গুলো যে ধীরে ধীরে ধারাবাহিক এসেছে তার সংক্ষিপ্ত রূপ সেইটি আমাদের অনুধাবন করতে হবে। বাঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে কিছু বলতে গেলে স্বাভাবিক ভাবে তার নিজের হাতে লিখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র কথা বলতে হবে। কারণ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করেছে। যদিও তার স্বপ্ন ছিল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে বাঙলার গরিব দুঃখীর ভাগ্য উন্নয়ন কিন্তু সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর পূর্বে তাঁর জীবনের ইতি ঘটেছে। যদিও গ্রন্থটিতে শুধুমাত্র ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত বর্ণীত আছে তবুও গ্রন্থটি প্রকাশিত না হলে হয়তো আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবনের অনেক অজানা তথ্য থেকে বঞ্চিত হতাম।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। রাজনীতিতে হাতেখড়ি হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির হাতে ১৯৩৮ সাল থেকে। তারপর থেকে একে একে তাঁর প্রত্যেকটি রাজনৈতিক কর্মকান্ড ধারাবাহিকভাবে বাঙলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছেন। স্বদেশী আন্দোলনের ভরাযুগ তখন গোটা ভারতবর্ষে। বঙ্গবন্ধু সবে স্কুলে পড়ছেন। আর সেই বয়সেই স্বদেশিদের বিভিন্ন সভায় যোগ দিতেন। নেতাজি সুভাস বসুর খুব ভক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, ‘ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এই দেশে থাকার কোন অধিকার নেই।
স্বাধীনতা আনতে হবে।’ সেই থেকে বাঙলার স্বাধীনতার বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় গেঁথে গিয়েছিল। ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে পড়ার সময় এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচয় ঘটে বাঙলার দুই নেতা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির সাথে। পরবর্তীতে তিনি কলকাতায় গিয়ে সোহরাওয়ার্দির সাথে যোগাযোগ এবং গোপালগঞ্জে মুসলিমলীগ ও ছাত্রলীগ গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে নেমে গেলেন এবং পুরো কলকাতায় ও পূর্ববঙ্গে খুব পরিচিত হয়ে উঠেন ছাত্রনেতা ও মুসলিম লীগের তরুণ নেতা হিসেবে। পর্যায়ক্রমে ভারতবর্ষ ভাগ হলো। সৃষ্টি হলো মুসলমানের আবাসভূমি পাকিস্তান। কিন্তু এই পাকিস্তান বাঙ্গালিদের জন্য তৈরি হলোনা। বঙ্গবন্ধু বুঝলেন পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। এই ষড়যন্ত্র থেকে বাঙ্গালিদের মুক্তি প্রয়োজন এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করার জন্য তিনি চলে এলেন ঢাকায়। তখন তাঁর বয়স ২৭। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। নেমে পড়লেন ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করা নিয়ে। শেখ মুজিবের আলোচনা চলল তখনকার ছাত্রলীগ কর্মী মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, নাঈম উদ্দিন, মোল্লা জামাল উদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ আরও অনেকের সাথে। সভা ডাকলেন ফজলুল হক হলে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। সভায় সিদ্ধান্ত হলো এ
একটি ছাত্র সংগঠন করা হবে যার নাম হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ।’ আহ্বায়ক করা হলো নাঈম উদ্দিনকে। একমাত্র অলি আহাদ রাজি হলেন না এই সংগঠনের সাথে থাকতে। তাঁর অভিযোগ ছিল সংগঠনটি সাম্প্রদায়িক। বঙ্গবন্ধু অলি আহাদকে অনেক করে বুঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘নামে কিছু যায় আসেনা, আদর্শ ও চেতনা যদি ঠিক থাকে তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবেনা। কয়েক মাস হলো পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি সেই মানুষিক অবস্থা থেকে জনগন ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।’ বঙ্গবন্ধুর যুক্তি সমসাময়িক ও যথার্থ ছিল। এবং দুই বছরের মধ্যেই আমরা দেখি সংগঠনটি থেকে পাকিস্তান নামক শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। ১৫০ মোগলটুলিতে সংগঠনের অফিস করা হল। সাইনবোর্ডে নাম দেওয়া হল মুসলিম লীগ ওয়ার্কস ক্যা¤প নামে। এই মোগলটুলির অফিসই পরে মুসলিমলীগ/আওয়ামীলীগের প্রাণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
১৯৪৮ সাল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, ঢাকার নবাব নাজিম উদ্দিন ও নুরুল আমীন সহ এদেশীয় দোসরগণ পল্টন ময়দানে ও কার্জন হলে ঘোষণা দেন- উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সেই সময় শেখ মুজিবের তারুণ্যদীপ্ত কণ্ঠে প্রতিবাদী সোচ্চার না না। সেই সাথে হাজারো কণ্ঠ মিলিয়ে প্রতিধ্বনিত হল না না না। রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গঠিত হল ভাষা সংগ্রাম কমিটি। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হলো বাঙলার একমাত্র ভাষা বাঙলা। সেই ভাষা আন্দোলনের নেপথ্য নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। । ভাষা আন্দোলনের একটি পর্যায়ে এখানে সমাপ্তি ঘটে ঠিকই। কিন্তু ’৫২ র ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনার ভেতর দিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ও মুসলিমলীগ সরকার স¤পর্কে পূর্ব বাঙলার মানুষের অনেকখানি মহামুক্তি ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তান ও মুসলিমলীগ সরকার যে পূর্ব বাঙলার মানুষের স্বার্থে নয় একথাটি সাধারণ জনগণ ব্যাপকভাবে উপলব্দি করতে শুরু করেন। সেইসময়কার পূর্ব বাঙলার আওয়ামী মুসলিমলীগের তরুণ ভারপ্রাপ্ত সাধারণ স¤পাদক শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের গণবিরোধী চরিত্র স¤পর্কে জনগণকে আরও সচেতন করে তুলতে সচেষ্ট হন। যার কারণে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববঙ্গে মুসলিমলীগের ব্যাপক ভরাডুবি হয় এবং বাঙ্গালিদের নির্বাচনী জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ ও পরবর্তীকালে আওয়ামীলীগ পূর্ব বাঙলার সরকার গঠন করে। অতঃপর ১৯৫৬ এর সংবিধানে বাঙলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সুতরাং ভাষা সংগ্রামের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙলার স্বাধীনতা আন্দোলনের অর্থাৎ বাঙ্গালিদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির স্বপ্নকে আরও একধাপ এগিয়ে নিল।
১৯৪৯ সাল। টাঙ্গাইলের একটি উপনির্বাচনে তখনকার ছাত্রনেতা শামছুল হকের মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিজয়ের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি হলো পূর্ব পাকিস্তানের রাজিনীতিক দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিমলীগ’। (এই রাজনৈতিক দলটি আওয়ামীলীগের গঠনের পটভূমি ছিল)। নতুন দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হলেন মাওলানা ভাসানী, সাধারণ স¤পাদক শামছুল হক আর শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম স¤পাদক। তখন বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। পরবর্তীতে জেল থেকে মুক্তি পেলে জেল গেটেই আওয়ামী মুসলিমলীগ জিন্দাবাদ, ছাত্রলীগ জিন্দাবাদ বলে স্লোগান উঠল । এই সময়টিতে বঙ্গবন্ধুর পরিবার থেকে চাপ আসে যে, বঙ্গবন্ধুর বাবা চাইলেন বঙ্গবন্ধু যেন বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারি করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাজি হলেননা। এই প্রসঙ্গে তিনি তাঁর আত্মজীবনী বইটিতে লিখেছেন আমার ভীষণ জেদ হয়েছে মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন দেখি তাঁর উল্টো হয়েছে। এর একটা পরিবর্তন করা দরকার। জনগণ জানত এবং আমাদের কাছেই প্রশ্ন করত। স্বাধীন হয়েছে দেশ তবুও মানুষের দুখ কষ্ট দূর হবেনা কেন? দুর্নীতি বেড়ে গেছে, খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে, বিনা বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের জেলে বন্দি করে রাখা হচ্ছে। বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মুসলিমলীগের নেতারা মানবেনা। পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গড়া শুরু হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেয়া হচ্ছেনা। রাজধানি করাচি। সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানের। পূর্ব বাঙলার কিছুই নেই। আব্বাকে সকল কিছুই বললাম। আব্বা বললেন, আমাদের জন্য কিছু করতে হবেনা ! তুমি বিবাহ করেছ, তোমার মেয়ে হয়েছে। তাদের জন্যও তো কিছু একটা করা দরকার। আমি আব্বাকে বললাম, আপনি তো আমাদের জন্য জমিজমা যথেষ্ট করেছন, যদি কিছু না করতে পারি, বাড়ি চলে আসব। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া চলতে পারেনা। আব্বা আমাকে আর কিছু বললেননা। রেনু বলল, এভাবে আর কতকাল চলবে? আমি বুঝতে পারলাম যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেনু আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেনু খুব কষ্ট বোধ করল কিন্তু কিছু বলতোনা।
পঞ্চাশের দশকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। বাঙ্গালিদের ন্যায্য দাবী প্রতিষ্ঠাসহ নিজস্ব স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করা যেন মূল লক্ষ্য হয়ে উঠে। পাকিস্তান থেকে বাঙ্গালিদের বের করে এনে বাঙালি জাতীয়তায় পূর্ব বাঙলার একটি আলাদা দেশ প্রতিষ্ঠা করাই যেন বঙ্গবন্ধুর ব্রত হয়ে উঠে। সংসার জীবনে একজন সফল সংসারি হয়ে উঠা হলোনা, শুধুমাত্র এই রাজনৈতিক জীবনের জন্য। পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন বাঙালির মুক্তির জন্য। সুতরাং ১৯৪৯ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিমলীগ’ গঠনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বঙ্গের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের বিষয়টি ফুটে উঠেছিল। বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ দাবীতে প্রকাশ হয় ১৯৬৬ সালে এসে ছয় দফা দাবীর মধ্য দিয়ে। যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিমলীগ, আওয়ামীলীগ গঠিত হল। ১৯৬৬ সালে ১৮, ১৯, ২০ মার্চ আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার ইডেন হোটেলে। কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফাকে দলের প্রধান মেনিফেষ্টো হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
পূর্ব বাঙলার জন্য পূর্ণ স্বায়ত্ব শাসনকেই আওয়ামীলীগের প্রধান নীতি বলে বিবেচনা করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ অনুমোদিত ছয়দফা ফর্মুলাটি নিুরূপ :
০১। দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সত্যিকার ধারণার ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশেষ করে সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির, আর সার্বজনীন বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ হবে সার্বভৌমত্বের অধিকারী।
০২। ফেডারেল সরকার মাত্র দুটি বিষয় পরিচালনা করবেন। এ দুটি বিষয় হল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়। আর অন্য সকল বিষয় ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে।
০৩। ক) দুটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা দুই অঞ্চলে প্রবর্তন করা যেতে পারে। অথবা
খ) গোটা দেশের জন্য একটি মাত্র মুদ্রা রাখা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধে শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকতে হবে। পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ রাখতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক রাজস্ব ও মুদ্রা নীতি গ্রহণ করতে হবে।
০৪। ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে করারোপ ও রাজস্ব ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। ফেডারেল কেন্দ্রের হাতে এরকম কোন ক্ষমতা থাকবেনা। তবে কেন্দ্র তার নিজ ব্যয় চাহিদা মেটানোর জন্য প্রদেশগুলির করের একটা অংশ পাবে। প্রদেশের সকল করের উপর একটি নির্ধারিত হারে লেবি থেকে একটা সর্বমোট সুসংহত তহবিল গড়ে উঠবে।
০৫। ক) দেশের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের জন্য দুইটি পৃথক বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রার হিসাব থাকবে।
খ) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
গ) ফেডারেল সরকার বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজনে দুই অঞ্চল কর্তৃক সমান হারে অথবা নির্ধারণযোগ্য অনুপাতে দুই অঞ্চল কর্তৃক মিটানো হবে।
ঘ) দেশজ পণ্য দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে শুল্কমুক্তভাবে অবাধে চলাচল করবে।
ঙ) শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে ফেডারেশনের ইউনিট সরকারগুলো বিদেশে বাণিজ্য মিশন খুলতে বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য বিষয় স¤পর্ক স্থাপন করতে পারবে।
০৬। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দলের পথ ধরে ২১ দফা কর্মসূচীর সপক্ষে ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ৬২ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙ্গালির স্বাধিকারের দাবী হয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য। ছয়দফায় কার্যক্রম পাকিস্তান রাষ্ট্রের ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে বাঙ্গালির জাতি রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষাকেই সুনির্দিষ্ট রূপ দেয়া হয়। এই ছয়দফার কারণেই বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার ও কারাগারে প্রেরণ করেন। কিন্তু থেমে থাকেনি আন্দোলন। ১৯৬৯ সালে এসে তীব্র গণআন্দোলনের মুখে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। ঠিক সেই সময়ে এক গণসংবর্ধনায় তোফায়েল আহম্মেদের ঘোষণায় শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন বাঙলার এককছত্র নেতা। আর মাত্র দু বছরের মধ্যে ছয়দফা রুপান্তরিত হয়ে যায় এক দফায়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছয় দফার সমর্থনে বাঙ্গালি জাতির বাংলাদেশের পক্ষে গণরায় ঘোষণা করে। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে আওয়ামীলীগ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করে। কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরেও ইয়াহিয়া-ভুট্টো ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেন। বঙ্গবন্ধুকে আপোষের পরামর্শ দেয়া হয় কিন্তু বঙ্গবন্ধু আপোষ করেননাই। তার পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। এরই মধ্যে ৩রা জানুয়ারি ১৯৭১ সালে রমনা রেসকোর্সে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যেদের শপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আবারো ছয়দফার ওয়াদার কথা বাঙ্গালিদের স্মরণ করিয়ে দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে রেসকোর্স ময়দানে স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম জনসভায় আনুষ্ঠানিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধু। এই স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যে দিয়ে বাঙ্গালির স্বাধীকারের কিংবা স্বাধীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রস্তুতির কথা বলেছিলেন। শেখ মুজিব সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
চূড়ান্তভাবে এই স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বে বঙ্গবন্ধু কিছু পূর্ব পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। যেমন ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে বসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সাথে টেলিফোনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিষয়ে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের সাথে বিরোধ নি®পত্তি না হলে কিংবা বঙ্গবন্ধু যদি নাও থাকে। তাহলে কে কি করবে বঙ্গবন্ধু পূর্ব থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ী নবনির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত জাতীয় পরিষদের সদস্যদের ভারতে ট্রেনিংয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা এবং তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয় তাহলে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কবিগুরুর — আমার সোনার বাঙলা, আমি তোমায় ভালবাসি — গানটি গ্রহণ করা হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে বাঙ্গালিদের যে সশস্র সংগ্রাম শুরু হবে সেটা বঙ্গবন্ধু পূর্ব থেকে আভাস পেয়েছিলেন। বেশ কয়েকবার কর্ণেল ওসমানী ও কর্ণেল রব, শেখ মনি, তোফায়েল আহম্মেদ এবং তাজউদ্দিন আহম্মেদের সাথে পৃথক পৃথক বৈঠকে তাদেরকে বিভিন্ন রণকৌশলের উপদেশ দিয়েছিলেন। যাই হোক ১৯৭১ সালে ৭ই মার্চের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ঘোষণা এবং ২৫ মার্চের দিবাগত রাতে ১২ টা ১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন ইপিআরের ওয়ারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা তাঁর পরিকল্পনার একটি অংশ। পর্যায়ক্রমিক বাংলাদেশকে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন দেশে রুপান্তরের জন্য যা যা করার প্রয়োজন সবকিছুই সুনিপুন এগিয়ে এনেছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতে কিভাবে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালিত হবে তার পরিকল্পনা তিনি দিয়েছিলেন। শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙ্গালিরা বিজয়ের পতাকা উড়াল বাংলাদেশে। বিশ্ব জানতে পারল রক্তসèাত একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যূদয়ের কথা। লাল-সবুজ পতাকার কোলে জন্ম নিল একটি দেশ-দেশটির নাম বাংলাদশ।
তথ্যসূত্র :
০১। বঙ্গবন্ধু কিভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন – মুনতাসীর মামুন।
০২। বাঙ্গালির ঐতিহ্য ও ভবিষ্যৎ – মোনায়েম সরকার।
০৩। বঙ্গবন্ধু ও বাঙ্গালির স্বপ্ন – নূহ-উল-আলম লেলিন।
০৪। বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকথা – ওয়াজেদ তালুকদার।
মো. আবুল কালাম আজাদ
বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতার্কিক
চেয়ারম্যান
ময়মনসিংহ ডিবেটিং সোসাইটি, ময়মনসিংহ।
ধশধুধফফবনধঃব@মসধরষ.পড়স