প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি দূর্ঘটনার পর বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মাঠে গরম হাওয়া বিরাজ করছে। বিশেষ করে বাসে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিয়ে চলতি সময়ে বিষয়টি নতুন রুপ নিয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কেবলমাত্র রাজধানীসহ অন্যান্য মহানগরে হাফ ভাড়ার বিষয়টি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে মালিক পক্ষ। তবে অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই চালক, সুপারভাইজার বা কন্ডাক্টর যাত্রী ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করছে এমনকি শিক্ষার্থী দেখলে বাসেই তোলতে চাচ্ছে না। এই নিয়ম হওয়ার ফলে রাজধানী ও অন্যান্য মহানগর বাদে বিশেষ করে মফস্বল এলাকার শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়েছে চরমভাবে। যা রেখাপাত করেছে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের মনে। এসব আন্দোলন নিয়ে সরকারি দল আবার বিরোধী দলের ইন্ধন থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদিও সাধারণ মানুষের ধারণা এটা আমাদের দেশের প্রচলিত রাজনীতির একটা নোংরা খেলার অংশ। কিন্তু একটা জিনিষ চোখের সামনে স্পষ্ট যে ইঙ্গিত যাই থাকুন না কেন জনগণ এ আয়োজ তুলেছে যে বাস মালিকদের নৈরাজ্যই গণপরিবহনে বিশংঙ্খলার জন্ম দিচ্ছে।
চলমান কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইত্যেমধ্যে লাল কার্ড প্রদর্শিত হয়েছে। দুই সপ্তাহের অধিক সময় ধরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে যাচ্ছে কিন্তু এদিকে বাস মালিক ও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন এতটা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না এসব বিষয় সমাধান করার জন্য। মিডিয়া গুলিও এ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে হয়তো কয়েকদিন পর এমনিতেই ঝিমিয়ে পড়বে এ উদ্যোগ যেটা হয়তো চাচ্ছে গণপরিবহনের মালিক পক্ষ। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বার বার বলা হলেও বাস্তবে হচ্ছে না বা ব্যর্থ হচ্ছে । অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সরকার বাস মালিকদের কাছে একেবারেই অসহায়। কিন্তু এ অসহায়ত্ব অস্পষ্ট তবে সাধারণ জনগণ কিন্তু ভূক্তভোগী।
রাজধানীর গণপরিবহনে শৃংখলা ফেরাতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাসমালিকদের অসহযোগিতায় তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এসব বিশৃংঙ্খলা কেবলমাত্র রাজধানীতেই কিন্তু নয় সারাদেশে এসব বিশৃংঙ্খলার ব্যাপ্তি রয়েছে আর তা কেবলমাত্র কিছু সংখ্যক বিআরটিসি বাসের পক্ষে সামল দেওয়া কোন ভাবেই সম্ভব না। রাজধানীর এসব অন্যায় বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও মাঠ পর্যায়ের বিষয়গুলি থেকে যায় অন্তরালে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে জনসাধারণের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে সরকার আসলে কোন পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করছে। সম্প্রতি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে সারা দেশে বাসভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে সরকার যে হারে বৃদ্ধি করেছে তার থেকে অনেকগুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে বাসভাড়া।
শুধু বাস নয় সে সাথে মাঠ পর্যায়ে চলা অন্যান্য যানবাহনের ভাড়া অযথা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ যেন ভাড়া বাড়নোর এক মহোৎসব। সেক্ষেত্রে মালিকপক্ষ অনেক বেশি লাভবান হয়েছে একথা অস্বীকার করা যাবে না। সেখান থেকেই জনমনে অসন্তোষ বিরাজ করছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যেসব দাবী করে আসছে তার মধ্যে অন্যতম হলো দুর্ঘটনার সাথে জড়িতদের বিচার ও নিহত পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া; সারা দেশে সব গণপরিবহনে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে হাফ পাস নিশ্চিত করা এবং কোন শর্ত না দেওয়া; গণপরিবহনে ছাত্রছাত্রী, নারীদের অবাধ যাত্রা ও ভালো ব্যবহার নিশ্চিত করা; ফিটনেস, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি ও চালককে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া; বিআরটিএর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; সব রাস্তায় ট্রাফিক লাইট, জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করা; জনবহুল রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো ও ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং শ্রমিকদের নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র নিশ্চিত করা।
এ ছাড়া চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ ও বাস দেওয়ার বদলে টিকেট ও কাউন্টারের ভিত্তিতে গোটা পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো; গাড়ি চালকের কর্মঘন্টা একনাগাড়ে ৬ ঘন্টার বেশি না করা; সড়ক পরিবহন আইন সংস্কার ও বাস্তবায় নিশ্চিত করা এবং চালক-সহকারীদের জন্য নিয়িমিত ডোপ টেস্ট নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থীরা যেসব দাবী তুলে ধরেছে সে দাবী গুলো গণমানুষের দাবী।
দাবীগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এসব দাবী সরকারের পক্ষ থেকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে গোটা সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন আসতে পারে। এর ফলে কেবল শিক্ষার্থীরাই উপকৃত হবে না হবে দেশের সকল মানুষ। কিন্তু বাসমালিকদের পক্ষ থেকে কোন দাবীকে গ্রহণ করা হচ্ছে না। বরং সরকার বাহাদুরও এব্যাপারে যথাযথ কোন ভূমিকা নিচ্ছে না। যার ফলে পরিবহণ ব্যবস্থায় বেড়ে চলছে নৈরাজ্য। ইতোমধ্যে আইনশৃংঙ্খলা বাহিনী কোথাও কোথাও একশনেও যাচ্ছে। আবার শিক্ষার্থীদের আন্দেলনকে পুঁজি করে বাইরের কিছু লোকজনও বিশৃংঙ্খলারও চেষ্টা করছে সরকারের একথাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। গণপরিবহনে যে নৈরাজ্য চলে আসছে তা দীর্ঘদিন এবং অব্যবস্থাপনার একটি ফসল। এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. শামসুল হকের ৪ ডিসেম্বর সময়ের আলো পত্রিকায় দেওয়া একটি বক্তব্যের উল্লেখ করতে চাই, ‘সিস্টেমের কারণে ঢাকার মতো জনবহুল একটা শহরে বাসের ব্যবসা লাভজনক নয়। এটা আমার কথা নয়, তিনটি স্টাডি করা হয়েছে সবগুলোতেই একই তথ্য পাওয়া গেছে। কেন হচ্ছে এমনটা ? এর জন্য দায়ী এই মালিক সমিতির নেতারাই। কারণ একেকটা করিডরে একাধিক কোম্পানির বাস নামিয়েছে। যেখানে কোন হিসাব-নিকাশ নেই। বাস নিয়ে আসছে, সরকার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। আবার যানজট ও বিশৃঙ্খলা রয়েছে। ফলে একটা বাসের যে প্রোডাক্টিভিটি, বেশি ট্রিপ দেওয়া সেটা কমে যায়। কিন্তু মালিক তার টাকাটা নিয়ে যায়।
যদি বেশি ট্রিপ দেওয়া যায় তা হলে শ্রমিকদের কাছে বেশি টাকা আসবে। কিন্তু যখনই যানজটের কারণে ট্রিপ কমে যায় তখনই চালক ড্রাইভার উগ্র হয়ে যায়। বেশি ভাড়া আদায় করেন। হাফ পাস চাইলে তারা মনে করে, তার পেটে লাথি লাগছে। এ কারণে তিনি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়।’ তবে এক্ষেত্রে কেবলমাত্র মালিকপক্ষকেই দায়ী করা সমীচীন নয় কারন এক্ষেত্রে সরকারের সঠিক ভূমিকা রাখা প্রয়োজন ছিল। বিভিন্ন সময় প্রায় সব সরকারই এ খাতকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাথার চেষ্টা করে আসছে। বিশেষ করে এব্যবসা খাতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা ভাগ বসিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সরকারের অনেক পদক্ষেপই সহজে কার্যকর করা যাচ্ছে না এ খাতে। সামান্য হাফ ভাড়ার বিষয়টিতেও প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। গণপরিবহণে নৈরাজ্যের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা বাড়ছে প্রাণহানি ও পুঙ্গত্ব।
ঘটনার পর বিভিন্ন সময় কিছু আন্দোলন লক্ষ্য করা গেলেও কয়েকদিন যাওয়ার পর থেমে যায় সবকিছু। গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয় ভূক্তভোগী পরিবারকে। মহাসড়কে দৃঢ় গতির গাড়ি না চলার নির্দেশনা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না এসব নিয়ম। নিয়মবর্হিভূতভাবে অবাদে লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি মহাসড়ক দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। মালিক সমিতির অসহযোগিতা ও প্রশাসনের নিরব সমর্থনে রাস্তায় চলছে বাতিলকৃত যানবাহন। হেলপারের হাতে চলে চলে এসেছে গাড়ির স্টিয়ারিং আর বেশির ভাগ ড্রাইভারই রয়েছে লাইসেন্স বিহীন। না দেখার ভান করেই চলে যাচ্ছে সময়ের পর সময় এযেন এক লুকোচুরি খেলা। এছাড়াও রাস্তায় রাস্তায় সংগঠনের নামে যে পরিমাণে চাঁদাবাজি হচ্ছে এর সঠিক পরিসংখান ও গন্তব্যস্থল জানা যায়নি। এমনকি মূল পৃষ্ঠপোষকদের পক্ষ থেকে এসব বন্ধের কোন দায়িত্বও নেওয়া হয়নি বরং এসব ব্যবস্থাকে লালন করে আসছে। এসব ভাগাভাগির বিষয়টিও গণপরিবহণ খাতকে চরম ধাক্কা দিচ্ছে। এসব দূর্বলতার কারনে মালিকপক্ষরাও তাদের ভাড়া বেশি আদায় করছে বলে জানা যায়।
সড়ক পরিবহণ আইন – ২০১৮ তে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান; কন্ডাক্টও লাইসেন্স; মোটরযান রেজিস্ট্রেশন, পরিবহণ কমিটি, রুট পারমিট; যানবাহন নিয়ন্ত্রণ; মোটরযানের নির্মাণ, সরঞ্জাম বিন্যাস ও রক্ষাবেক্ষণ; ট্রাফিক ও ওজননসীমা নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ দূষণ; দূর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা এবং বীমা, মোটরযান ড্রাইভিং স্কুল, মোটরযান মেরামত কারখানা, ডাম্পিং ইয়ার্ড; অপরাধ, বিচার ও দন্ড; পুনবিবেচনা ও আপিল ও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। আইনে উল্লেখিত বিষয়গুলির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে গণপরিবহণে নৈরাজ্য বন্ধ করা সম্ভব। সকলের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। কেবলমাত্র ব্যবসার চিন্তা পরিহার করে মালিকপক্ষকে সেবার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এ নৈরাজ্য দূর করার জন্য। এই নৈরাজ্য দূর হলে রাস্তায় দুর্ঘটনার পরিমাণ যেমন কমবে তেমনি কমবে আসবে মৃত্যুর মিছিল। এইক্ষেত্রে সরকার, পরিবহণ মালিক ও জনসাধারণকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
লেখক পরিচিতি
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী
প্রভাষক ,আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ
সভাপতি, ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাব
ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ
০১৭১২-৬৯১৩৬৪০৮.১২.২০২১