কেন্দুয়া (নেত্রকোণা) প্রতিনিধি :
নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার বিশিষ্ট বাউলশিল্পী ইসলাম উদ্দিন আর নেই। উপজেলার সান্দিকোনা ইউনিয়নের খিদিরপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে শনিবার সকাল সাড়ে ৮টায় দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও এক কন্যা সন্তানসহ বহু ভক্তবৃন্দ ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
উপজেলার খিদিরপুর গ্রামের মরহুম আজমত আলী ও মা চান্দের মায়ের কোল আলোকিত করে বাউল ইসলাম উদ্দিনের ১৯৫৬ সালে ৮ই অক্টোবর জন্ম হয়। স্কুল জীবনেই বাউল গান সাধনা শুরু করেন।
আপন মামা বাউল রঙ্গো মিয়ার গানে আকৃষ্ট হয়ে শুরু তার ছন্নছাড়া উদাসী বাউল জীবন। স্কুল জীবনে দর্শক মাতানো বাউল ইসলাম সান্দিকোনা স্কুল অ্যান্ড কলেজে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ গ্রহণ করেন। শুরু হয় বাউল জীবন। শাস্ত্র ও গানের তত্ত্ব শেখার জন্য কেন্দুয়া উপজেলা বৈশ্যপাট্টা গ্রামের প্রখ্যাত বাউল সাধক আবেদ আলীর কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সংগীত সাধনায় অল্প সময়েই তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তিনি ওস্তাদ আবেদ আলীসহ বাউল ইস্রাফিল, আব্দুল মজিদ তালুকদার, বাউল ইদ্রিছ মিয়া, বাউল মকবুল হোসেন সরকার, বাউল গিয়াস উদ্দিন, বাউল মাহাতাব উদ্দিন, বাউল দুদু মিয়া, বাউল শুনীল চন্দ্র কর্মকার, বাউল শামছুন্নাহার, বাউল আব্দুস সালাম, বাউল কিতাব আলীসহ বহু গুণী বাউলের সঙ্গে পালা ও মালজোড়া করেছেন তিনি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতেও গান গাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে একাধিকবার।
বাউল শাস্ত্র ও বাউল তত্ত্ব সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে ১২ই জানুয়ারি নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ একঝাঁক তারকা অভিনেতা ও শিল্পী নিয়ে গ্রামের বাড়ি কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে এলে এক সংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ ও তার স্ত্রীকে নিয়ে একটি গান ও কবিতা পাঠ করে হুমায়ুন আহমেদসহ সবার মন কাড়েন। এরপর থেকে তিনি হয়ে ওঠেন নন্দিত কথাসাহিত্যিকের ঘনিষ্ঠ সহচর।
এ লোকশিল্পী প্রায় তিন বছর আগে স্ট্রোকে আক্রান্ত প্যারালাইসিসে রোগশোকে ভূগছিলেন।
তিনি হুমায়ূন আহমেদের ‘উড়ে যায় বক পক্ষী’, ‘চন্দ্র কারিগর’, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘এনায়েত আলীর ছাগল’, ‘অদেখা ভুবন’, ‘চৌধুরী খালেকুজ্জামানের বিশ্ব রেকর্ড’, ‘চৌধুরী খালেকুজ্জামানের এভারেস্ট জয়’, ‘থ্রি-টু-ওয়ান জিরো অ্যাকশান’সহ ১৩টি নাটক, দুটি চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ও ‘নয়ন নম্বর বিপদ সংকেত’ এবং তিনটি বিজ্ঞাপন চিত্রে গান ও অভিনয় করেছেন ইসলাম উদ্দিন।
তার অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নব্বই দশক ও পরবর্তী সময়ে দেশজুড়ে পরিচিতি পান এ বাউল শিল্পী।
একজন গীতিকার, লেখক ও পল্লী সংস্কৃতি সংগ্রাহক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন ইসলাম উদ্দিন।
তার রচিত প্রায় সহস্রাধিক গান আজও অপ্রকাশিত। গানের পাশাপাশি কয়েকটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করলেও অর্থাভাবে সেগুলো প্রকাশ করতে পারেননি এ শিল্পী।
তার উল্লেখযোগ্য পাণ্ডলিপিগুলো হচ্ছে- ‘নেত্রকোণার লোকসাহিত্য’, ‘নেত্রকোণার আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’, ‘শাফিউল মজনবীন’, ‘পদ্যাকারে মহানবীর জীবনী’ এবং নাটিকা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’।
শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সান্দিকোনা স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থান দাফনকাজ সম্পন্ন করা হয়। নামাজে জানাজায় বহু ভক্ত, বাউল শিল্পী,সাহিত্যিক, জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশ নেন।
তাঁর মৃত্যুতে গাভীর শোক ও শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান,নেত্রকোণা-৩ আসনের সংসদ সদস্য অসীম কুমার উকিল, তাঁর সহধর্মিণী অধ্যাপিকা অপু উকিল,বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতা রফিকুল ইসলাম হিলালী, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ নুরুল ইসলাম, ইউএনও মইনউদ্দিন খন্দকার,ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম প্রমূখ।