কলিহাসান,দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি:
নেত্রকোনার দুর্গাপুরে কাকৈরগড়া ইউনিয়নের লীপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন মো. এখলাছ উদ্দিন। কিশোর বয়সে নিঃসন্তান ছোট খালামনির আশ্রয়ে লালিত পালিত হন তিনি। কিশোরগঞ্জের করমপট্টিতে কেটেছে শৈশব। প্রাথমিক শিাজীবন শুরু হয় কিশোরগঞ্জে। তিনি কাকৈরগড়া ইউনিয়নের মৃত সমেশ আলী ওরফে সওকত আলীর জৈষ্ঠ পুত্র।
১৯৭১ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ গুরু দয়াল কলেজের বিএসসি(১ম বর্ষে অধ্যয়নরত)ছিলেন। তখনকার কিশোরগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ও গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত বার্ষিকী সম্পাদক ছিলেন। খরমপট্টি খালার বাসায় বসবাস করতেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ এর সাথেই বেশীরভাগ সময় কেটেছে উনার।
সকল প্রকার, মিটিং মিছিলে আব্দুল হামিদ সঙ্গেই থাকতেন। ২৫শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পরই দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মার্চের শেষ কয়দিন এবং এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত আব্দুল হামিদ এর ব্যবস্থাপনায় এখলাছ উদ্দিন ২৫/৩০ জন কর্মী তৎকালীন অবসর প্রাপ্ত সেনা প্রশিকের অধীনে আজিম উদ্দিন হাই স্কুল মাঠে সংপ্তি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২০শে এপ্রিল বিকেলে কিশোরগঞ্জ শহরে পাকিস্থানী আর্মি আসছে বুঝে ওঠা মাত্রই আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মীবৃন্দ কিশোরগঞ্জ শহর ত্যাগ করে গুহাটি এলাকা দিয়ে ভারত চলে যান।
তাঁর আগেরদিন মো. এখলাছ উদ্দিন বসন্ত রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তখন তিনি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া এলাকার এক পূর্ব পরিচিত লোকের বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় আশ্রয় নেন। গুটি বসন্ত সারতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়। তারপর ঐ এলাকায় কিছুদিন থেকে নিকটবর্তী কয়েকটি গ্রামের যুবকদের সংগঠিত করে ভারত যেতে উৎসাহিত করেন। তারপর তিনি দুই শতাধিক যুবক নিয়ে ভাটি এলাকা দিয়ে ভারতের মহেশখলা চলে যান। পূর্বে প্রেরিত অনেক যুবক সেখানে অবস্থান করছিল। তিনিও সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করেণ।
যুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মহেশখলা এসে এখলাছ উদ্দিনের সাথে সাাৎ করেন এবং সবাইকে নিয়ে ঢালু যাওয়ার পরামর্শ দেন। ওই সময় অনেক আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মী এখানে সমবেত ছিল। ৯৬৭ জন কর্মী নিয়ে আমি মহেশখলা ইয়ুথক্যাম্প ইনচার্জ ও বি.এস.এফ কর্তৃপরে স্বারিত রোড পাস নিয়ে তুরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মহেশখলা হতে ১২০ মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে ঢালুর উদ্দেশ্য রওনা হন। পথে লংরা, বাঘমারা, শিববাড়ির প্রভৃতি ক্যাম্পসমূহে রাত্রি যাপন করেন। ওইসব ক্যাম্প কর্তৃপ খাবারের ব্যবস্থা করেন। ঢালু ক্যাম্পে পৌছেই অধ্য মতিউর রহমান এর সাথে সাক্ষাত করি।
ঢালু ইয়ুথক্যাম্পের ইনচার্জ হিসাবে তাঁদের সকলকে ঢালু হাই স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করেন এবং পরদিন সকালে তাঁদের কয়েকজনকে ইয়ুথ ক্যাম্পের সম্মুখে ৪/৫টি তাবু টানিয়ে থাকার সুবিধা করে দেন। ইয়ুথক্যাম্প ও হাইস্কুল পাশাপাশি অবস্থিত। ১/২ দিন পরেই ঢালু থানায় নাম রেজিস্ট্রেশন করা হয়। অতঃপর ক্যাম্প ইনচার্জ মহোদয় জনৈক শাহনেওয়াজ খান নামক তৎকালীন ই.পি.আর প্রশিক্ষকের মাধ্যম সকলকে পিটি প্যারেড ও আংশিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন। ওই অবস্থায় কয়েকদিন পর যুদ্ধরত ক্যাপ্টেন হামিদ (নিকনেইম) তাঁদের ক্যাম্পে আসেন এবং বাছাই করে ৪০/৫০ জন যুবক ট্রাকে তুলে পুনরায় মহেশখলা নিয়ে যান। ওই সময়ে তিনি তাঁদেরকে রাইফেল পরিচিতি ও পরিচালনার জন্য সংপ্তি প্রশিণ দেন।
এফ.এফ ক্যাম্পে খাদ্য ও অন্যান্য রসদ সামগ্রী সরবরাহের জন্য ভারতের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপরে সংঙ্গে বন্দোবস্ত করেন। অতঃপর তিনি একজনকে এডজুটেন্ট ও এখলাছ উদ্দিনকে ডেপুটি এডজুটেন্ট করে ১৩ জনের ষ্টাফ নিয়োগ দিয়ে ক্যাম্পে রেখে বাকী সকল যুবকদের নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। রণাঙ্গন থেকে কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামের জন্য, চিকিৎসার জন্য বা রসদ সামগ্রীর জন্য মো. এখলাছ উদ্দিনের এফ.এফ ক্যাম্পে আসতেন। যতটুকু সম্ভব সেবা দেয়ার তিনি চেস্টা করেছেন।
মহেশখলা ইয়ুথক্যাম্পের ইনচার্জ জনৈক মতিউর রহমান একজন রোগাক্রান্ত জোয়ানকে দিয়ে মো. এখলাছ উদ্দিনের নিকট চিঠি পাঠান। তখন ওই সময়ে ওই রোগাক্রান্ত জোয়ানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেন তিনি। ওই সময়ে ভুটান গ্রুপের নিকটাআত্মীয় সমর্পণকৃত ৪ জন রাজাকারকে তাঁদের ক্যাম্পে প্রেরণ করেন।
এর ১/২ দিন পর ক্যাপ্টেন সাহেব পত্র দ্বারা আদেশ দিয়ে ৫ জন এফ.এফ সহ তাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে যান এবং নেত্রকোণা জেলাধীন খালিয়াজুরি থানায় লেপসিয়া বাজার ও মোহনগঞ্জ থানার গাগলাজুর বাজারে অবস্থানের নির্দেশ দেন।তখন তিনি বলেন উনার যুদ্ধকালীন সময় সচিব এখানে অবস্থান করবে। তিনি আসার পর এলাকাবাসী ক্যাপ্টেন এর বরাবরে লিখা কয়েকটি দরখাস্ত তাঁর নিকট জমা দেন।
২/৩টি দরখাস্ত উনার নিকট পৌঁছাতে পেরেছি। বাকীগুলি এখনও ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে তাঁর কাছে রয়েছে বলে মো. এখলাছ উদ্দিন এ প্রতিবেদককে জানান। এই অবস্থায় দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। দেশ স্বাধীনের ৫/৬ দিন পর কিশোরগঞ্জ যাওয়ার আদেশ প্রাপ্ত হয়ে মো. এখলাছ উদ্দিন করিমগঞ্জ হয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে প্রবেশ করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মো. এখলাছ উদ্দিন ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ এডভোকেট সাহেবের নেতৃত্বে দেশ গড়ার কাজে আত্ম নিয়োগ করেন। ৩ মাস যেতে না যেতেই জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট থেকে কিশোরগঞ্জ মহকুমা সদরে একত্রিত হওয়ার আবেদন আসতে থাকে।
সেই মোতাবেক তিনি সহ ২/৩ জন মিলে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক মহোদয়ের স্বারিত অনুমতি নিয়ে আর্টস কাউন্সিল হলে সমাবেশের আয়োজন করেন। ১৭/০৪/১৯৭২ইং তারিখে মুক্তিযোদ্ধাদের মহান মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
সেই সমাবেশে কিশোরগঞ্জ মহকুমা মুক্তিবাহিনী নামে কমিটি গঠিত হয় এবং তাঁকে দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। কমিটির কার্যক্রম চলতে থাকে। ইতিমধ্যে তিনি বি.এস.সি পাশ করেণ এবং কিশোরগঞ্জেই অবস্থান করতে থাকেন। হঠাৎ করে কুচক্রী মহল ১৫ই আগস্ট ভোর বেলা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর দশ বছরের শিশু সস্তান শেখ রাসেল সহ সপরিবারে বুলেটবিদ্ধ করে নির্মমভাবে হত্যা করে।
তারপরই সব এলোমেলো হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এর প্রত্যক্ষ নির্দেশে প্রথমে জঙ্গলবাড়ি হাই স্কুলে শিকতা শুরু করেন ও এক বছর পরই ব্যাংকে চাকুরী নিয়ে টাঙ্গাইল চলে যান।
১৯৯৬ সনে আওয়ামী লীগ মতায় আসার পর যখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই বাচাই পক্রিয়া শুরু হয়। অথচ দুর্গাপুর থানার ২ জন কমান্ডার এবং নেত্রকোণা জেলার একজন কমান্ডারের সনদপত্র প্রত্যয়ন রয়েছে এ যোদ্ধার। ২০১৪ ইং জামুকা’র অনলাইনে আবেদন করেন। ২০১৮ ইং সনে উপজেলা পর্যায়ে যাচাইয়ে তিনি উপস্থিত হন। তবে উক্ত যাচাইয়ে তিনি বাতিল হয়ে যান।
ভারতের প্রশিণ কেন্দ্রে সমূহে যারা প্রশিণ নিয়েছেন যদি শুধু মাত্র তাহাদের নামই তালিকাভূক্ত হতো তাহরে এ যোদ্ধার কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেই তালিকাভূক্ত করা হয়েছে বিধায় তিনিও তালিকাভূক্তির দাবিদার হয়েছেন। তাঁর সাথের সহযোদ্ধারা তালিকাভূক্ত করা হয়েছে এবং নিয়মিতভাবে ওইসব মুক্তিযোদ্ধারা ভাতাও পাচ্ছে।
তাঁহলে তিনি কি দোষ করলেন! ভাতাপ্রাপ্ত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যয়নপত্র তাঁর আবেদন পথে গাঁথা রয়েছে। শুধু তিনিই বঞ্চিত রয়েছেন। মহেশখলা এফ.এফ ক্যাম্পে দায়িত্বপালন করেছেন ও যুদ্ধেেত্র অংশগ্রহণ করেছেন। সব প্রমাণপত্র রয়েছে তাঁর হাতে। তাহলে কেন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আজও স্বীকৃতি মেলেনি এ যোদ্ধার।
কবে মিলবে স্বীকৃতি এ আকুতি নিয়ে দ্বারস্ত হচ্ছেন অনেকের কাছে কোথায় ঠাঁই পাচ্ছেন না তিনি। এজন্যই দেশ স্বাধীন করেছিলাম, কিন্তু স্বীকৃতি কেন পাবো না! কবে তালিকাভূক্ত হতে পারব বলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ভুক্তভোগী মো. এখলাছ উদ্দিন।