স্বজন ডেস্ক : গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের কথা বলা যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে খুনের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে আশ্রয় দেয়, সে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদকে ফিরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানালেও দেশটি তাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে না দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) সুপ্রিম কোর্ট প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ এবং ন্যায় কণ্ঠ’ শীর্ষক মুজিববর্ষ স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে উল্লিখিত প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সংবিধানে জাতির পিতা একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের কথা বলেছিলেন। দেশের মানুষ ন্যায়বিচার পাবে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে বিচারের বাণী নীরবে কেঁদেছে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হলো। সেই অধ্যাদেশে বলা হলো—১৫ আগস্টের খুনিদের বিচার করা যাবে না। ওই হত্যাকাণ্ডে মামলা করা যাবে না। বাংলাদেশে ১৯৭৫-এ কী ঘটেছিল—হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্র। শুধু রাষ্ট্রপতিকে নয়, পুরো একটি পরিবারকে হত্যা। কারবালায় শিশু-নারীকে হত্যা করা হয়নি। আমরা হারিয়েছি আমাদের পরিবারকে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তাদের সব অধিকারই হারিয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘ক্ষমতায় এসেছিল খন্দকার মোশতাক সংবিধান লঙ্ঘন করেই। কয়েকজন জুনিয়র অফিসার তার সাথে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারই প্ররোচনায় এ ঘটনা। তার সঙ্গে যে ষড়যন্ত্রকারী ছিল, সেটা এখনও বের করা হয়নি। একদিন সেটিও বের হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘খুনিরা জাতির পিতাকে যখন হত্যা করল, মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিলো। আসলে বেঈমান বা মুনাফিক যারা হয়, তাদের মানুষ ব্যবহার করে, কিন্তু রাখে না। আসল যে থাকে, সে থাকে পর্দার আড়ালে। সেই পলাশীর যুদ্ধেও মীর জাফর ব্রিটিশ কোম্পানির সাথে ষড়যন্ত্র করে নবাব হওয়ার আশায়। সে তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। মোশতাকও থাকতে পারেনি। পর্দার আড়াল থেকে আসল লোক জিয়াউর রহমান চলে আসে।’
বিচারপতি সায়েমের কাছ থেকে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান যখন চিফ মার্শাল ল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হলো, তখন সেনাপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে নিলো। ক্ষমতা হাতে নিয়েই রাষ্ট্রপতি হলো। একই সাথে সেনাপ্রধান এবং দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিলেন। আমাদের আর্মি রুলসে ছিল—সেনাপ্রধান কখনো নির্বাচন করতে পারবে না। কিন্তু জিয়াউর রহমান হিসেবে নিজেকে শুধু রাষ্ট্রপতি ঘোষণাই দেয়নি, গণভোটের নামে হ্যাঁ-না ভোটের প্রহসন করলো। তারপর আবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও করলো। তখন তিনি ঘোষিত রাষ্ট্রপতি আবার সেনাবাহিনীর প্রধান। আমার প্রশ্ন—গণতন্ত্রটা তাহলে কোথায়? সেনাপ্রধান এবং ঘোষিত রাষ্ট্রপতি আর্মি রুলস যেমন ব্রেক করল, সংবিধানও লঙ্ঘন করল। ক্ষমতায় এসে দলও গঠন করল।’
পিতা হত্যার বিচার না পাওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাহলে আমার অধিকারটুকু ছিল কোথায়? মৌলিক অধিকার কোথায় ছিল সে সময়? আমি যদি বেঁচে না থাকতাম বা ক্ষমতায় আসতে না পারতাম, এই বিচার কোনোদিন হতো না। কেউ ছিল না সাহস করে কিছু বলার। কিন্তু আমাদের সংবিধানে ন্যায়বিচার পাওয়ার কথা বলা আছে।’
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মধ্যে যারা পালিয়ে আছে, তাদেরকে খোঁজা হচ্ছে, জানিয়ে তার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমেরকিা ন্যায়বিচারের কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে, ভোটাধিকারের কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে। কিন্তু আমাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছিল, আমরা যে ন্যায়বিচার পাইনি। তারপর যখন বিচার হলো, তখন খুনিদের আশ্রয় দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সে দেশে যখন যে রাষ্ট্রপতি এসেছে, আমি সব রাষ্ট্রপতির কাছে বলেছি যে, সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের কিভাবে আশ্রয় দেন? আপনাদের জুডিশিয়াল কিভাবে আশ্রয় দেয়? খুনি রাশেদকে কেউ ফেরত দিলো না। আমেরিকা গণতন্ত্রের কথা বলে আর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, কেন আমি জানি না। তারা নাকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ।’
‘আমি প্রত্যেক রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিয়েছি, বারবার আবেদন করেছি, বারবার চেষ্টা করেছি…। কানাডায় মেজর নুর ছিল, ৩২ নম্বরে যে কমান্ডিং অফিসার হিসেবে কাজ করেছে। কর্নেল ফারুক ছিল ট্যাংকের দায়িত্বে। নুর কানাডায় আর রাশেদ আমেরিকায়। তাদের কাছ থেকে আইনের শাসনের কথা শুনতে হয়, গণতন্ত্রের কথা শুনতে হয়, ন্যায়বিচারের কথা শুনতে হয়। এটা আমার কাছে অবাক লাগে’, বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিচার বিভাগের উন্নয়নের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত হয়েছে। মানুষ যেন ন্যায়বিচার পায়, সরকার সেদিকে লক্ষ রেখেছে।’
প্রধান বিচারপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভার্চুয়াল কোর্ট করে দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতেও মানুষ বিচার চাইতে পারে। করোনায় যখন সারা বিশ্ব স্থবির, তখনও বিচার হচ্ছে। ভার্চুয়াল কোর্টের কারণে বিচার স্থগিত হয়ে যায়নি। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’
ইংরেজিতে রায় লেখার পাশাপাশি যাতে বাংলায় লেখা হয়, সেজন্য আলাদা ট্রান্সলেটর নিয়োগ দেওয়া এবং তাদের প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কলকাতা থেকে পাস করে তিনি এখানে আইন বিভাগেই ভর্তি হন। তার স্বপ্ন ছিল—আইনজীবী হবেন। কিন্তু সেটি হয়নি। ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার মধ্যেই তিনি তিন বার গ্রেপ্তার হন। ১৯৫২ সালে তিনি অনশনে থাকাকালীন মুক্তি পান। তিনি চেয়েছিলেন এই ভূখণ্ডে যাদের বসবাস, তাদের সুন্দর জীবন হবে। শিক্ষা, চিকিৎসা সবকিছু পাবে। একটা উন্নত জাতি হিসেবে মাথা উচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ছিল। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জীবনভর আন্দোলন করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন।’
স্মরণিকা প্রকাশ করতে যারা পরিশ্রম করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।