গারো সংস্কৃতিতে বাঙ্গালি সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়

সিস্টার দিপালী আরেং

প্রকাশিত: ২:০০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০

সংস্কৃতিই একটি জাতির পরিচয় বহন করে। সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে একটি জাতিকে আলাদাভাবে চেনা যায়। একটি জাতির কৃষ্টি-সংস্কৃতিই সেই জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সংস্কৃতির উপাদান হলো- খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-অনুষ্ঠান, ব্যবহার্য বস্তু, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্র, প্রথা ইত্যাদি। এগুলো সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ, তবে এগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সংস্কৃতি মূলত হয় দু ধরনের: ১। বস্তগত: ২। মানস/মানসিক বস্তগত: ঘরবাড়ি, রীতিনীতি, ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, খাদ্য, বস্ত্র এবং কারুশিল্প: (ভাস্কর্য,স্থাপত্য,আল্পনা,চিত্রকলা), সাহিত্য, শিল্প, দর্শন, চিন্তাচেতনা এবং আধ্যাত্মিক চর্চা।
প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতির বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষ্টি-সংস্কৃতি রয়েছে। এছাড়াও বাংলার প্রকৃতি ও ভৌগলিক অবস্থানও সংস্কৃতিকে দান করেছে স্বাতন্ত্র্য। সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, মাটির ভাস্কর্য, কারুশিল্প,বয়ন ইত্যাদি এদেশের মানুষকে করেছে অসাম্প্রদায়িক এবং দান করেছে মানবিকতা।

সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের অধিকারী এই বাংলাদেশ। কালের বিবর্তনের প্রেক্ষিতে বহু বিচিত্র জনপদের রূপান্তরের মাধ্যমে নানান জাতির মানুষের সংমিশ্রনে গড়ে উঠেছে এ দেশ। এ দেশে বাঙালি ছাড়াও রয়েছে আদিবাসি জনগোষ্ঠির বসবাস, যাদের সমাজ বিজ্ঞানীরা নৃ-ত্বান্তিক জনগোষ্ঠিী বলে অভিহিত করেন: যেমন সাওতাল, গারো, উড়াও, চাকমা, মারমা, রাখাইন, ত্রিপুরা ইত্যাদি। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি, বিভিন্ন আদিবাসি দল এবং বিশেষ সম্প্রায়ের সংখ্যালঘু সকলকে নিয়েই বাংলাদেশ। সবার অর্থাৎ প্রতিটি জনগোষ্ঠীর একটিই পরিচয় বা জাতীয়তা বাংলাদেশী। দৈহিক, অবয়ব, বর্ণ, গোত্র, জাতি, গোষ্ঠী মিলে বাংলার মানুষকে দান করেছে অপরূপ সুন্দরের স্বকীয়তা।

ভাষার দিক থেকেও বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। অঞ্চল ভিত্তিক কথ্য বাংলাতেও পার্থক্য দেখা যায়। এমন কি কথা বলার ভঙ্গিমা, সুর, কথা বলার রীতি ইত্যাদিতেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অপর দিকে যতগুলি আদিবাসি গোষ্ঠী রয়েছে তাদের ততটি ভাষা। আদিবাসি জনগোষ্ঠীর কিছু কিছু ভাষা, সাহিত্য উন্নত এবং সমৃদ্ধ যেমন: চাকমা, গারো, সওতাল ইত্যাদি। গারো ও সাওতাল ভাষা রোমান হরফে লেখা কিন্তু চাকমা ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে। তবে বেশির ভাগ আদিবাসি ভাষাই অলিখিত।
এ দেশে উল্লিখিত বসবাসরত আদিবাসিদের মধ্য থেকে গারো আদিবাসিদের কথা ও কৃষ্টি সংস্কৃতির বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস গ্রহণ করছি।

গারোদের উৎপত্তি ও তাদের আদিনিবাস সর্ম্পকে শতভাগ তথ্য দেয়া বড়ই কঠিন ব্যাপার। কারণ এ বিষয়ে কোন লিখিত তথ্য বা কোন প্রমাণ নির্ভর ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তবে বংশ পরম্পরায় যে লোককাহিনী চালু রয়েছে এবং নৃ-বিজ্ঞানীদের মতামত অনুসারে বলতে পারি গারোরা প্যালিও মংগলীয় শ্রেণিভূক্ত তিব্বতী-বর্মণ জনগোষ্ঠীর অর্ন্তভূক্ত এবং তাদের আদি নিবাস বর্তমান চীনের উত্তর পশ্চিম এলাকার সিন-কিয়াং প্রদেশে। পরবর্তীকালে প্রতিকূল আবহাওয়া এবং পরিবেশগত নানান কারণে তারা আদিনিবাস ত্যাগ করে তিব্বত হতে হিমালয়ের দুর্গম গিরিপথ অনুসরণ করে করে ভূটান হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। সেই সময় এ এলাকায় কোন জনমানব ছিল না। তারা বন জঙ্গল সাফ করে জুম চাষ করে জীবীকা নির্বাহ করতো। বর্তমানে বাংলাদেশের জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় গারোদের বাস দেখা যায়। গারোরা নিজেদেরকে আচিক অথবা মান্দি বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। গারোদের রয়েছে নিজস্ব মূল্যবোধ, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, স্বকীয়তা সামাজীক জীবনাচরণ ও ধর্মীয় বিশ্বাস ।

গারো সম্প্রদায়ের প্রচলিত বিভিন্ন প্রথা সম্বলিত পুস্তক পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন গোত্র ও আঞ্চলিকতার নিরিখে বাস্তব জীবন পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে, গারো সমাজে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথা ও রীতি-নীতি রয়েছে যার দ্বারা এ সম্প্রদায়ের মনুষের জীবনাচরণ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এ সকল প্রথা অলিখিত হলেও হাজার বছর ধরে গারোরা তা মেনে আসছে এবং তাদের জীবনে অনুশীলন করে আসছে। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী এ সকল প্রথা নানাভাবে বিবর্তিত হচ্ছে। যুগের আবর্তনে কোন কোন প্রথার কার্যকারীতা হ্রাস পেয়েছে অনেকাংশে। প্রয়োজনীয় চর্চা, সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও গবেষণার অভাবে প্রথাসমূহের বিশুদ্ধতা নষ্ট হচ্ছে। পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী গারোরা তাদের বসতবাড়ি বনজাত দ্রবাদি যেমন: বাঁশ, কাঠ, বেত, শন প্রভৃতির সাহায্যে নির্মাণ করে থাকে। গৃহস্থলীর যাবতীয় জিনিষপত্রাদি রাখার জন্য আলাদা একটি ঘরও নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা এবং শিক্ষিত পরিবার আধুনিক পদ্ধতিতেও ঘর তৈরি করে চারপাশে নানান ফলমূলের গাছপালাসহ বাড়িকে সাজিয়ে রাখে। কাজেই বাঙালিদের বসতবাড়ি ও গারোদের বসতবাড়ির মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য দেখা যায় না।

গারোদের প্রধান খাদ্য ভাত। প্রধানত: আঠালো সুগন্ধি চাল গারো ভাষায় যাকে মিমিত্তম বলে এবং মিসীমি বাঁশের চুংগায় ভাপে সিদ্ধ করা হয়- এ ধরনের রান্না করা ভাত অতি উপাদেয়। নাখাম অর্থাৎ শূটকী মাছ গারোদের অন্যতম প্রিয় খাদ্য। বর্তমানে বাঙালিদের মতোই গারোরাও নাখাম অর্থাৎ শূটকী মাছের পাশাপাশি ভাজি, ভর্তা, ডাল, মাছ, খিচুরী, পোলাও আহার করছে। নানা জাতের পশু-পাখির মাংস তন্মধ্যে খাসী, মুরগী, শূকর প্রিয় মাংস তাদের। আলু জাতীয় খাবারের মধ্যে থাবলচু (শিমূল আলু) আমপেং ও থামলাং ( মিষ্টি আলু) এবং ফলের মধ্যে কলা, কাঁঠাল, আনারস, তরমুজ, ফুটি ভূট্টা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
গারো সমাজের সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রায় দেশি পঁচুই মদের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক উৎসবে, অতিথি আপ্যায়ণে এবং পূজাপার্বণে পঁচুই মদ গারোদের অপরিহার্য।

গারো মেয়ে বা মহিলার দকমান্দা, ব্লাউজ, ওড়না প্রভৃতি ব্যবহারের পাশাপাশি বর্তমানে শাড়ি, পাজামা, সালোয়ার এবং আধুনিক পোষাক পরিচ্ছদ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। মহিলারা গলায় হার হিসেবে আগেকার দিনে সিঁকিসরা, আধুলিসরা, টাংকাসরা ব্যবহার করত। এখন নানা ধরনের আধুনিক অলংকারদিও ব্যবহার করে থাকে। অপরদিকে গারো পুরুষরা ধূতি, হাফপ্যান্ট, জামা, গেঞ্জি, লুঙ্গি, ফুলপ্যান্ট ও চাঁদর ব্যবহার করে থাকেন। অতীতে গারো পরিবার একেকটি যৌথ পরিবার ছিল। গারো সমাজে যৌথ পরিবারে ভাঙ্গন ধরেছে তাতে সন্দেহ নেই।

বর্তমান গারো সমাজের পরিবার ব্যবস্থাকে যৌথ পরিবার বলা যায় না। জীবিকার পরিবর্তন, ব্যক্তি স্বার্থ, শিক্ষাদীক্ষার প্রসার ইত্যাদির কারণে আজ গারো পরিবার একক পরিবার অবস্থানে দাঁড়িয়েছে কিন্ত পারিবারিক শিষ্টাচার আজও অব্যাহত রয়েছে। গারোদের এমন কিছু অলিখিত সামাজিক অনুশাসন রয়েছে যা তারা দৈনন্দিন জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বতোভাবে মেনে চলার চেষ্টা করে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এ প্রথাসমূহের বেশ কিছু বিবর্তন হয়েছে বটে, তবে এর ব্যবহার এখনো বর্তমান। গারোদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকে যে কতিপয় সামাজিক প্রথা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সেগুলো হচ্ছে খিম্ প্রথা, নক্না-নক্রম্ প্রথা, মাহারী প্রথা, আগাত্তে চাওয়ারী প্রথা, মানক্, জিক্ছল, চ্রা-পান্থে প্রভৃতি।

সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ, ভাষা ও অন্যান্য অনেক প্রথাসমূহে বর্তমানে আমরা লক্ষ্য করি যে বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। যেমন সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রথায় দেখি এখন অনেক গারো মা-বাবা রয়েছে যারা কন্যা সন্তানের পাশাপাশি ছেলে সন্তানকেও সম্পত্তি প্রদান করছে। আবার অপরদিকে বিবাহের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় যে, গারোরা সাধারণত মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অধিকারী হওয়া সত্বেও বিবাহের ক্ষেত্রে এখন কেউ কেউ বাঙালিদের মত বউ নেওয়া শুরু করেছে। তাদের ভাষায় বাংলা ভাষার অনেক শব্দ ডুকে গেছে। অনেকে আচিক ভাষা ভুলে গেছে। বাংলায় অনর্গল কথা বলছে। এভাবে আমরা লক্ষ্য করি যে, গারো সমাজ ও সংস্কৃতিতে বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট।

লেখক পরিচিতি: রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের একজন সিস্টার (নান)।