সাধারণভাবে প্রত্যেকটি সমাজে প্রচলিত একটা মানদন্ড থাকে। এসব মানদন্ডের লঙ্গন করাকে অপরাধ বলা হয়ে থাকে। আর এসব অপরাধীকে রাষ্ট্র শাস্তি দিয়ে থাকেন। মনুষ্য সমাজে প্রতিদিন অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলছে এবং অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাতেও কিন্তু অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। যদি আমরা দেখি অপরাধের কারন কি ? এটি একটি সামাজিক সমস্যা।
মানব সভ্যতার শুরু থেকেই অপরাধ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। পৃথিবীর এমন কোন সমাজ ব্যবস্থা নেই যেখানে অপরাধ এবং অপরাধী নেই। তবে স্থান ভেদে অপরাধ প্রবণতা কম বেশি হতে পারে এবং অপরাধের ধরণটাও ভিন্ন হতে পারে। সম্প্রতি দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলীর উপর নৃশংস হামলা চালানো হয়। এছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা হত্যাকান্ড বেশ আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
সামাজের উচ্চ পর্যায়ের লোকজনের উপর হামলা এবং হত্যা হলে দেখা যায় সাধারণ মানুষের উপর চরমভাবে প্রভাব পড়ে এবং প্রতিবাদও হয় অনেক। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা না হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এপদটি সরকারের যাবতীয় পলিসি মাঠে প্রযোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। করোনা কালে সারা দেশের প্রায় সব ইউএনওগণ একেবারে জনগণের ঘরের দরজা পর্যন্ত যেতে পেরেছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিজস্ব কোন দপ্তর না থাকলেও প্রত্যেক দপ্তরের দেখা শুনার দায়িত্ব রয়েছে। কর্ম পরিধিও ব্যাপক হচ্ছে দিন দিন। সকল অফিস তদারকি, সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখাশুনা, বিভিন্ন ধরণের ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করাসহ যাবতীয় কাজকর্ম সম্পাদন করতে হচ্ছে।
স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি দেখার কারণে একটা সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে বলে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে সামনে আসছে। তাই এর বিচার সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে না হলে কর্মকর্তারা ভবিষৎতে সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় গুলো ভালোভাবে তদারকির ক্ষেত্রে অনিহা প্রকাশ করতে পারে। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসাতে জড়িয়ে পড়ায় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে মতবিরোধ বেড়েই চলছে প্রতিনিয়ত। মানুষের মধ্যে অতি সহজেই ধনী হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে রাজনৈতিক প্লাটফর্মকেই বেছে নিচ্ছে কিছু সুবিধাভোগী মানুষ। যার ফলে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মাঝে। সংসদ থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ে বিরোধী দলের অবস্থান সুসংহত না থাকার কারণে সরকারি দলের মাঝেও সৃষ্টি হচ্ছে দলীয় কোন্দল। অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার পিছনে এসব কারনও অনেকটাই দায়ী একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। মানুষ যেসব কারণে অপরাধ করার সাহস পায় তার মধ্যে অন্যতম হলো সঠিক সময়ে বিচার না হওয়া। দীর্ঘদিন আলোচনায় থাকার পর আস্তে আস্তে মানুষের মন থেকে উধাও হতে থাকে এসব অপরাধের বিষয়। অনেক সময় দেখা যায় যেসব অপরাধ ঘটে তার পরের বছর গুলিতে এই দিনে হয়তো বিভিন্ন মিডিয়া সেটা আবার সামনে নিয়ে আসে।
নিউজের হেড লাইন হয় বিচার না পাওয়ার এত বছর ! তখন আবার মানুষের মনে একটু নাড়া দেয়। আর যেসব বিষয় মিডিয়াতে আসে সেসব বিষয় নিয়ে হয়তো সারা দেশে প্রতিবাদ হয় তখন সরকারের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ একটু নড়ে চড়ে বসে এবং বিচার পাবার পথ তৈরি হয়। অন্যদিকে যেসব ঘটনা মিডিয়াতে আসে না সেসব বিষয় অনেক ক্ষেত্রেই চলে যায় নির্বাসনে। বিচার প্রার্থীরা আইনের দরজায় ঘুরে নিঃস্ব হাতে বাড়ি ফেরে। ফলে সঠিক সময়ে বিচার না হওয়ায় তৈরি হয় বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের অনাস্থা। ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসারের উপর হামলার পর বিভিন্ন দিক থেকে অভিযোগের তীর উঠেছে। তবে এই বিষয়ে অফিস কর্মচারী রবিউল ইতোমধ্যে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে স্বীকারোক্তি প্রদান করেছে। যদিও এর পূর্বে আরেকটি তদন্ত টিমের মাধ্যমে আরো কয়েকজনের নাম এসছিল তাই এতে করে মানুষের মাঝে সন্দেহের জন্ম নিয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনীর তদন্তের উপর। কারন সাধারণ জনগণ এখন জজ মিয়া ঘটনার মতো নাটক আর দেখতে চায় না। সঠিক তদন্ত শেষে ঘটনার সত্যতা জানতে চায় সাধারণ জনগণ।
তদন্ত যত দেরি হয়ে তত মানুষের মাঝে তৈরি হচ্ছে অনাস্থা সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রতি। তাই এসব তদন্ত দ্রুত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করা এখন সময়ের দাবী। পুলিশি তদন্তে বারবার সময় ক্ষেপণের ফলে বিচারে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘসূত্রিতা । তবে তাড়াহুড়া করে রিপোর্ট প্রদান করাও যুক্তিসঙ্গত নয়। সঠিক তদন্ত করে ঠিক সময়ে আদালতে রিপোর্ট উপস্থাপন করা জরুরি। ঠিক সময় ও সঠিক তদন্তে বিচার সঠিক হলে আস্থা বাড়ে এবং অপরাধী অপরাধ করার পূর্বে বারবার বিচেনা করে। আর এসব বিষয়ে সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিতে না পারলে অপরাধীরা শাস্তির আড়ালেই থেকে যাবে। আর তখন সরকারকে জনগণের মুখোমুখি হতে হয়। আর তখন সন্দেহের তীর চলে যায় সরকারের দিকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক ও পরিবারকে হত্যার পর সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের বিচার না করার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বিচার ব্যবস্থাকে কুলষিত করা হয়েছিল। এতে করে বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ জনগণের একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করলে সে বাঁধা উঠে গিয়ে বিচারের পথ সুগম হয় এবং জনগণের হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস কিছুটা হলেও ফিরে আসে। তবে এই সফলতার পর মানুষ কিন্তু সাগর রুণি, মিতু, তনু আলোচিত হত্যাকান্ডের বিচারও দেখতে চায়। এসব হত্যাকান্ডের বিচার সঠিক সময়ে না হলে আবার বিরুপ ধারণাই তৈরি হবে সাধারণ জনগণের মাঝে।
লেখক পরিচিতি
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী