নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার
আইন শৃংখলা রক্ষা, জনগণ ও সম্পদের নিরাপত্তা এবং অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা প্রশংসার দাবী রাখে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এদেশের পুলিশের নাম রাখা হয় ইষ্ট বেঙ্গল পুলিশ । ভারত ভাগের পরবর্তী পর্যায়ে নাম ধারণ করে হয়ে ইষ্ট পাকিস্তান পুলিশ ।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এই নামেই চলে পুলিশের কার্যক্রম । মাঝে মাঝে ব্যক্তি পুলিশের কিছু দায়ভার পুলিশ বাহিনীর উপর বর্তাচ্ছে একথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। তবে এসব বিষয় স্বল্প সময়ের জন্য কালিমা লেপন করলেও পেশাদার পুলিশ বাহিনী তাদের কর্মদক্ষতার মাধ্যমে এসব অভিযোগ অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত পুলিশ বাহিনী এদেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা এবং শৃংখলা বজায় রাখার জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে।
ষোল কোটি মানুষের দেশে এত অল্প সংখ্যক বাহিনী দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদান করা সত্যিই দুরুহ কাজ। কারণ অনেক জায়গায় আইন ভাঙ্গাটা ক্রেডিটই মনে করেন অনেকেই।
এই দুরুহ ব্যাপারটিকে সাবলিলভাবে নিয়ে মানুষের দৌঁড়গোড়া পর্যন্ত পুলিশ বাহিনী সেবা দিয়ে যাচ্ছে। চুরি ডাকাতিরোধ, ছিনতাই প্রতিরোধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ভিআইপিদের নিরাপত্তা, সমাজ বিরোধী কর্মকান্ডসহ বিভিন্ন জনসভা, নির্বাচনী দায়িত্বে বাংলাদেশ পুলিশ অংশগ্রহণ করে থাকে।
বর্তমানে পুলিশের পুরুষ সদস্যের পাশাপাশি মহিলা সদস্যরাও দেশের অভ্যন্তরে এমনকি দেশের বাইরে সমানতালে কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে।
এমনকি মহিলা সদস্যরা বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিতও হওয়ার কারণে মহিলাদের মাঝে আত্মতৃপ্তি জন্ম নিচ্ছে। পুলিশের সাধারণ বিভাগ ছাড়াও সিআইডি, রেলওয়ে পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান, ইমিগ্রেশন পুলিশ, শিল্পাঞ্চাল পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ,পর্যটন পুলিশ, নৌ পুলিশ, পিবিআই এর মত ভাগে বিভক্ত হয়ে সেবা প্রদান করে আসছে দেশের মানুষকে।
তবে যে হারে জনসংখ্যা এবং অপরাধ প্রবনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সে হারে বাড়েনি পুলিশের সংখ্যা।
পুলিশ বাহিনী দেশের শান্তি শৃংখলা নিয়ন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৮৯ সালে নামিবিয়ায় প্রথম জাতিসংঘের শান্তি মিশনের প্রতিনিধি হিসেবে পুলিশ বাহিনীর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাত্রা শুরু করে।
অদ্যবধি পর্যন্ত শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত সফলতার সহিত দায়িত্ব পালন করে আসছে। এইসব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার ফলে পুলিশের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি করোনাকালীন সময়ে মানুষের আস্থা অর্জন এবং আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে পেশাদারিত্বের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা অতুলনীয়।
বিশেষ করে ৯৯৯ এ কল করে বাংলাদেশের একমাত্র আইন-শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের সেবা গ্রহণ করেছে এদেশের সাধারণ জনগণ।
বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে মানুষ যখন ঘর বন্দি তখন পুলিশ বাহিনী সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক বেশী মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় বিট পুলিশিং কার্যক্রমও জনপ্রিয় হচ্ছে। এতসব সফলতার পরও সাধারণ মানুষ কখনও কখনও পুলিশ বাহিনীর প্রতি আস্থা ধরে রাখতে পারছে না।
এর কারণ হিসেবে পুলিশ বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যদের অমানবিক কাজই দায়ী। যার দায়ভার বহন করতে হচ্ছে সমগ্র পুলিশ বাহিনীকে। আর এসব অমানবিক কাজ এতসব সফলতা ম্লান করে দিচ্ছে। বিশেষ করে মানুষ বিপদেই পুলিশের দ্বারস্থ হয়ে থাকে ।
আর বিপদের সময় পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে সঠিক সেবা না পাওয়ার কারণে পুলিশের প্রতি খারাপ ধারণা জন্ম নিচ্ছে। এমন একটা ধারণা জন্মেছে যে ঘুষ এবং প্রভাব প্রতিপত্তি ছাড়া পুলিশের নিকট সঠিক বিচার পাওয়া সম্ভব নয়।
সম্প্রতি কক্সবাজারের টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশ বাহিনীর কিছু লোক মেজর (অব.) সিনহাকে যেভাবে হত্যা করেছে তা অবশ্যই পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্বকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এঘটনার প্রেক্ষাপটে অপরাধীরদের গ্রেফতার এবং কক্সবাজার জেলার বিশাল পুলিশ বাহিনীকে বদলী করা হয়েছে।
কেবল বদলী এবং গ্রেফতারের মাধ্যমেই যেন এই অপরাধের বিচার ঢাকা না পড়ে সে বিষয়ে পুলিশ বাহিনীকেই ভূমিকা নিতে হবে। ইতোপূর্বে গতানুগতিকভাবে ভাবে এসব বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড চলে আসছে তবে যারা এসব হত্যার স্বীকার হয়েছে তাদের বেশির ভাগই তালিকাভূক্ত অপরাধী ছিল।
তাই হয়তো সেভাবে বিচারের জন্য ঝড় উঠেনি। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড কোন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য মঙ্গলজনক নয়।
ক্ষণিক সময়ের জন্য আত্মতৃপ্তির জন্ম দিলেও বিচার ব্যবস্থার জন্য অশনি সংকেত। কারণ এই সিস্টেমের সুযোগ নিয়ে বাহিনীর বিপথগামী সদস্যরা হয়তো সাধারণ মানুষের উপরও চালাতে পারে এ হত্যাকান্ড। মানুষের আস্থা বাড়াতে সম্প্রতি পুলিশ বাহিনীর সদস্যদেরও ডোপ টেস্ট করানো হচ্ছে।
এবং বেশ কিছু সদস্যের মাঝে পজেটিভ রেজাল্ট আসে যার প্রেক্ষিতে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে যা ইতিবাচক ফল নিয়ে আসবে জনসাধারণের মাঝে।
পুলিশ বাহিনীর চাকুরি অন্যান্য বিভাগের চাকুরি থেকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় সরকারকেও বিশেষ নজর দিতে হবে।
বিগত কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ বাহিনীর উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা এ বাহিনীকে আধুনিক বাহিনীতে রুপ দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে তা আশা করা যায়।
একসময় পুলিশ বাহিনীর প্রতি সমাজের মানুষের যে অনাস্থা তৈরি হয়েছিল তা থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে।
পুলিশ দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃংখলা রক্ষায় যে ভূমিকা পালন করে আসছে সে জায়গায় তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতির জায়গাটাও রাখতে হবে। জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় পুলিশের আত্মশুদ্ধিতে পুলিশের অবস্থান সুদৃঢ় করা সম্ভব।
জনগণের আস্থার জায়গাটা তৈরি না হলে পুলিশের সফলতার গল্পগুলি ও জনসাধারণের নিকট অর্থহীন হয়ে যায়। সফলতার গল্প গুলি তখনই পুলিকে সাহস দিবে যদি সফলতার গল্প বারবার হয় এবং এটা সবসময়ের জন্য। পুলিশের আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সকলেই নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করলেই জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব।