বাজেটে কর্মসংস্থানে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি – প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার

প্রকাশিত: ৯:০৭ অপরাহ্ণ, জুন ১৯, ২০২১

বাজেট শব্দটি প্রান্তিক মানুষের নিকট খুব একটা পরিচিত নয় তবে এর ফলাফল ভোগ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। জুন মাস এলেই শোরগোল শুনা যায় বাজেট নিয়ে বিশেষ করে ব্যবসায়ী মহলে। বাজেট সংসদে উপস্থাপন হয় আবার আলোচনাও হয় । এক পর্যায়ে সরকারি দলের সদস্যদের সমর্থনে পাসও হয়।

বিরোধী দল কখনও ওয়াক আউট আবার কখনও বিরোধিতা । যদিও সংসদে বাজেট আলোচনায় সংসদ সদস্যরা বাজেট আলোচনার চেয়ে অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন বেশি। সরকারের জনকল্যাণমুখি বাজেট আর বিরোধী দলের জনবিরোধী

বাজেট। এসব শব্দ আমাদের নিকট খুব পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ বাজেট ভাবনাকে ভিন্নভাবে দেখে থাকে। সাধারণ মানুষের ভাবনায় থাকেনা রিজার্ভ কিংবা জিডিপি। বুঝে না আমদানী রপ্তানি নীতিমালা। জানে না বাজেট ঘাটতি কি এবং কেন ? শুধু বুঝে কোন জিনিষের দাম বাড়বে আর কোন জিনিষের দাম কমবে। যদিও আমাদের দেশে জিনিষের দাম কমার সম্ভাবনা খুই কম।

একবার যেকোন প্রকারে জিনিষের বেড়ে গেলে তা কমার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তথাপি প্রান্তিক সাধারণ মানুষ গুলো আশায় থাকে একটু ভালো থাকার প্রত্যাশায়। বেঁচে থাকতে চায় স্বপ্ন নিয়ে দুবেলা দুমুঠো ভাত খেয়ে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনটি দল দেশের ক্ষমতায় গিয়েছে কিছু ভিন্ন সময় বাদ দিলে। সবার চেষ্টাই ছিল দেশের উন্নতি এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে চাওয়া এবং সে চাওয়া বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক ফারাক লক্ষ্য করা গেছে।

প্রতিবারই বাজেট হয় জনগণের কথা বিবেচনা করে তবে সেখানে প্রান্তিক মানুষের কতটা ভাবা হয় সেটা বিবেচ্য বিষয়। দিন দিন বাজেটের আকার বাড়ছে যার ফলে প্রতিবারই বাজেটের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ বাড়ছে উৎপাদন বাড়ছে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে তাই বাজেটের আকার বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক।

এ অর্থ বছর জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বিশাল অংকের বাজেট ঘোষণা করেছেন। যার মধ্যে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা এবং ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সত্যিকার অর্থে করোনা কালে এ বিপুল অংকের বাজেটের হিসাব মেলানো কষ্টকর।

তবে করোনাকালের এ বাজেটে ব্যয় সংকোচনের বিষয়টি আরো গুরুত্ব দেওয়া যেত। ‘জীবন- জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ – শিরোনামের এ বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে করোনা ভাইরাস মোকাবেলার বিষয়টি। বিশেষ করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিতে নিয়ে আসা এ বাজেটের অন্যতম দিক বলে উপস্থাপন করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে যে পরিমাণ ঘাটতি দেখানো হয়েছে তা জিপিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। উত্থাপিত বাজেটে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ যা অর্থের আকারে ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা । প্রশ্ন হচ্ছে এ জিডিপি এই করোনা মহামারী কালে অর্জন সম্ভব কি না ? একটি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সঠিক মূল্যস্ফীতি বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি । গত বাজেটে ৫ দশমিক ৪ শতাংশে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখার কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী কিন্তু গত এপ্রিলে এটা কিছুটা বেড়ে ৫ ধশমিক ৫৬ শতাংশে দাঁড়িছে। এটা এবছর ধরা হয়েছে ৫. ৩ শতাংশ।

করোনা কালে এ মূল্যস্ফীতি ধরে রাখা কঠিন বলেই ধরে নেওয়া যায়। রাজস্ব খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই। বাজেটের এইসব বিষয় অর্জন করতে হলে সত্যিকার অর্থেই একটি ব্যাপক চ্যালেঞ্জ নিতে হবে সরকারকে।

বাজেটে যে পরিমাণে ঘাটতি দেখানো হয়েছে সে ঘাটতি মোকাবেলায় সরকার বৈদেশিক ঋণ এবং দেশের অভ্যন্তর থেকে ব্যাংক ঋন নেওয়ার প্রস্ত্বানা করেছেন। দেশের অভ্যন্তর থেকে ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়াটা খুব একটা জটিল বিষয় নয়। ব্যাংকিং খাত থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার লক্ষমাত্রা থাকলেও তারল্য সঙ্কট হবে না আশ্বস্ত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফজলে কবির । যদিও অর্থমন্ত্রী আশার কথা বলেছেন যে, আমরা এখন ঋণ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু ঋণ এর সঠিক ব্যবহারটা সুন্দর হওয়া বাঞ্চনীয়।

অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে বিগত সময়ের চেয়ে এবছরের বাজেট বাস্তবায়ন অনেকটাই চ্যালেঞ্জ এবং কষ্টসাধ্য। বাজেটে সাধারণত যেসব পণ্যের উপর শুল্ক-করহার বাড়ানো হয় সেসব পণ্যের দাম সাধারণত বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এ বিচারে এবছর মুঠোফোন, মাশরুম, শিল্প লবণ , চুইং গাম, বিদেশি রড ও সমজাতীয় পণ, বিদেশী মাংশ, বিদেশী গাজর-টমেটো, বিদেশী সাবান, বিশেী বিস্কুট এর দাম বাড়তে পারে।

বাজেটে নতুন করে কর আরোপ না করায় চাল, ডাল, চিনি, লবণ, পাউরুটি, সাবান, বোতলজাত পানি, ফলের জুস, মসলা ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের দাম বাড়ার কথা না। তবে সমস্যাটা হলো বাজেট ঘোষণার সময় কোন নিয়মনীতি না মেনেই ব্যবহার্য জিনিষ পত্রের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয় যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। সব দোষ চলে যায় বাজেটের উপর। কিন্তু সমস্যাটা হলো এসব পণ্যের পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যায় বাজার নিয়ন্ত্রণহীনতার ফলে। যার ফলে বাজেটের সুফল সাধারণ মানুষ পায় না। বুঝতে পারা যায় না বাজেটের সুবিধা অসুবিধা ।

ফলে আমরা ধরেই নিয়েছি যে বাজেট হলে সকল পণ্যের দাম বাড়বেই। গত বছর স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্ধ ছিল ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা এ বছর তা বাড়িয়ে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। করোনা মোকাবেলায় এবাজেট নিতান্তই অপ্রতুল। তবে যা বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে তা থেকে বরাদ্ধ বাড়ানো যেমন জরুরি তেমনি দুর্নীতিমুক্ত রেখে এ বাজেট ব্যবহার করাটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিবারই বাজেটে কালো টাকা সাদা করার একটা প্রক্রিয়া থাকে। আর এ নিয়ে সবাই নেগেটিভ কথা বললেও বাজেটে সে প্রক্রিয়াটা সচল থেকেই যায়। যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন কালো টাকা আর অপ্রদর্শিত আয় এক নয়। অপ্রদর্শিত আয় সিস্টেম লসের কারণে হয়ে থাকে। মোট কথা হচ্ছে কালো টাকা বন্ধ করতে হলে এ টাকার উৎস মুখ খুঁজে বের করে মুখ বন্ধ করতে হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে দেশের মানুষের জীবিন জীবিকা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে যে বাজেটের কথা বলা হয়েছে তা বাজেট বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করবে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সামাজিক বেষ্টনির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখাতে বরাদ্ধ বাড়িয়ে মানুষকে সরকারি সেবার আওতায় আনা প্রয়োজন। এদিকে নজর দিয়ে সরকার সামাজিক নিরাপত্তায় প্রথমবারের মতো লাখ কোটি বরাদ্ধ রেখেছে বাজেটে। তবে সবচেয়ে বড় কথা দেশে প্রচুর পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করা গেলে দেশের অর্থনীতি উদ্ধার করা অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়বে।

বিশেষ করে বেসরকারি পর্যায়ে সরকারের সহযোগিতার মাধ্যমে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলতে না পারলে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে না। এ বাজেটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুস্পষ্ট কোন দিক নির্দেশনা চোখে পড়ার মতো নয়। এমন কি উদ্যোক্তা তৈরি করার ক্ষেত্রে বাজেটে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করা দের মধ্যে বৈদেশিক রেমিট্যান্স অন্যতম। করোনার কারণে এ খাত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। লাখ লাখ প্রবাসী তাদের কর্ম থেকে বিচ্যুতি হয়েছে। এর ফলে রেমিট্যান্সের যেমন প্রভাব পড়বে অন্যদিকে বেকারত্বের পরিমাণও বাড়বে। তাই এখাতে সুস্পষ্ট নীদিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে সঠিক নির্দেশনা প্রয়োজন। করোনাকালে যারা দেশে ফিরে এসেছে তাদেরকে আবার পাঠানের ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ উদ্দ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন ।

সরকারি চাকুরেদের বিশেষ করে নিচের স্তরের কর্মচারীদের ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনদিন। স্কেল পরিবর্তন না করে প্রতিবছর ৫% বৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রায় অর্থনৈতিক বাঁধার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। কারন এ বৃদ্ধিতে স্কেল প্রদানের চেয়ে লাভবান হচ্ছে কম চাকুরেরা। করোনার প্রভাবে শিক্ষাখাতের অর্থনৈতিক দিক লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যারা শিক্ষাথীদের টিউশন ফি দিয়ে চলে। তাদের দিকে বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন ছিল।

কৃষি নির্ভর দেশে কৃষির আধুুনিকায়নের উপর গুরুত্ব বেশি দেওয়া প্রয়োজন। আর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বাজেট কৃষির গুরুত্ব অনুধাবন করে সঠিক বরাদ্ধের এবং কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে কৃষককে সহযোগিতা করণের সুস্পষ্ট নীতিমালা। যদিও এক্ষেত্রে কৃষিপণ্য উৎপাদনের ৬ খাতে ১০ বছরের কর অবকাশের কথা বলা হয়েছে। অবশ্য সব খাতেই করোনা উপলক্ষ্যে ব্যাপক পরিমাণে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু সেই প্রণোদনা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সরকারি সহযোগিতার নিয়মনীতি গ্রহীতা বান্ধব না হলে এ কাজে সফলতা আসবে না কোনভাবেই।

দেশে থেকে প্রতিবছর যে হাজার হাজর কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে তা উদ্ধার করা গেলে বাজেট আরো স্বয়ংসম্পূর্ন করা যেত। সব মিলিয়ে বাজেট কেবল হতাশা যুক্ত নয় । অনেক ভালো থিম এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে অর্থনৈতিক চাকায় সংযুক্ত করার অনেক বিষয় এখানে অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গের কর্মী নিয়োগে কর ছাড়ের বিষয়টি বিশেষ সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার আশা যোগাচ্ছে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো উন্নয়নশীল দেশে বাজেট একটি জটিল বিষয়। এখানে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি সে তুলনায় প্রাপ্তি কম। প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা হচ্ছে বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। অপরপক্ষে যে বাজেট করা হয় তার ব্যবহারটা সঠিক দুর্নীতিমুক্তভাবে করা গেলে সাধারণ মানুষ সুফল পেত অনেক।

করোনাকালের এ বাজেট জনবান্ধব হবে এই প্রত্যাশা প্রান্তিক মানুষ অবশ্যই করতে পারে এ সরকারের নিকট। বাজেটের সকল সুফল জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেব তখনই যখন সমাজের উপরের স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। আর এ ক্ষেত্রে সরকার পরিচালানায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের দায়বদ্ধতা সবচেয়ে বেশি। সবমিলিয়ে লাখ লাখ তরুনদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করণের মাধ্যমে বাজেটের বাস্তবায়ন জরুরি।

লেখক পরিচিতি
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ
সভাপতি, ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাব
০১৭১২-৬৯১৩৬৪