মো. আবুল কালাম আজাদ
সাধক ও গীতিকার উকিল মুন্সী নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামে ১৮৮৫ সালের ১১ জুন জন্মগ্রহণ করেন। একদিকে মসজিদের ইমাম অন্যদিকে একতারা হাতে গণমানুষের প্রিয় গীতিকার এক অপূর্ব বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে তাঁর জীবনাচার ও গানে। তাঁর গুরু ছিলেন আরেক বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন।
উকিল মুন্সীর পারিবারিক নাম আব্দুল হক আকন্দ। দশ বছর বয়সে বাবাকে হারান। আব্দুল মজিদ নামে তাঁর এক ছোট ভাই ছিল। গৃহশিকের কাছে শৈশবেই বাংলার পাশাপাশি আরবি, ফারসি ও কোরআন শিক্ষা নেন। বাবার মৃত্যুর পর হাসানপুরে মা উকিলেন্নেসার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। হাসনপুরে কয়েক বছর থাকার পর দুই ভাই বাবার বাড়ি ফিরে আসেন। তারপর কিশোরগঞ্জের ইটনার ঠাকুরবাড়িতে ফুফুর কাছে থাকেন কিছুদিন। সে সময়ে নেত্রকোনায় ঘাঁটুগানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। তিনি ১৭-১৮ বছর বয়সে ঘাঁটুগানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এর মাধ্যমে তাঁর সংগীত জগতে প্রবেশ। বিশ শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি থেকে গায়ক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন।
তরুণ বয়সে বেড়াতে আসেন মোহনগঞ্জ থানার জালালপুর গ্রামে চাচা কাজী আলিম উদ্দিনের বাড়িতে। এ গ্রামের সাধারণ কৃষক লেবু হোসেনের মেয়ে লাবুশের মা‘র (হামিদা খাতুন) প্রেমে পড়েন। তাকে নিয়ে লিখেন – ‘ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে, সোনার জালালপুর/সেখানেতে বসত করে উকিলের মনচোর।’ প্রেমের কথা জানাজানি হলে আভিজাত্যের প্রশ্ন তুলে কাজী বাড়ির লোকেরা বাধা দেয়। ফলে জালালপুরের থাকা বা যাতায়াত করা বন্ধ হয়ে যায়। হতাশায় কিছুদিন জালালপুরের আশেপাশে শ্যামপুর, গাগলাজুর, জৈনপুর গ্রামে পাগলের মতো ঘোরাঘুরি করেন। ১৯১৫ সালে জালালপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে মোহনগঞ্জের বরান্তর গ্রামের মসজিদে ইমামতি ও আরবি পড়ানোর কাজে যোগ দেন। ইমামতির পাশাপাশি সারারাত স্বরচিত গজল গেয়ে সময় কাটান।
১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে লাবুশের মায়ের ইচ্ছায় গোপনে তাদের বিয়ে হয়। লেবু হোসেন একটি বসতবাড়িসহ তিন একর জমি দান করেন। তখন থেকেই জালালপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ইতোমধ্যে তাঁর গানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি ছিল। কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির স্বজনরা জানাজার ইমামতির জন্য তাঁকে ডাকতেন। এমনও হয়েছে যে, গানের আসরে বিরতি দিয়ে জানাজার নামাজে ইমামতি করতে হয়েছে। একসময় মানুষ গান শুনে স্বপ্ন দেখেছে যৌবনের প্রেম ভালবাসার। বৃদ্ধকালে আল্লাহ প্রেমের গানে দুচোখের পানিতে ভিজেছে পাকা লম্বা দাঁড়ি। নামাজে, জানাজায়, প্রার্থনায় তিনি নয়নের জলে বুক ভাসিয়েছেন। মানুষও কেঁদেছে অঝোর ধারায়।
১৯১৮ সালের ১৭ এপ্রিল প্রথম সন্তান প্রখ্যাত গায়ক আব্দুস সাত্তারের জন্ম হয়। এরপর তিনি মদন থানার কুলিয়াটি গ্রামে চলে যান। কুলিয়াটিতে পাঁচ বছর কাটান। গ্রামটি উকিলকে ঘিরে গীতিকবি-গায়কদের মিলনকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এসময় হবিগঞ্জের প্রখ্যাত পীর সৈয়দ মোজাফফর আলী (র.) এর শিষ্যত্ব নেন ও তারপর থেকেই একতারা বাজিয়ে গান করতে শুরু করেন। মধ্য বয়সে যখন স্রষ্টার প্রেমে মগ্ন হয়ে জীবনের সেরা গানগুলি রচনা করেন সেই সময় তিনি হবিগঞ্জের শরিয়তের পীর মোজাফফর আহম্মদ সাহেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার মাধ্যমে। পীর সাহেবের আশীর্বাদ ও নির্দেশনায় হয়ে উঠেন বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত স¤পদ। মানুষ তাঁকে মসজিদে ইমাম বানিয়ে তার মাধ্যমে মহান প্রভুর বন্দেগী করার তৃপ্তি পেতেন।
এক পর্যায়ে জালালপুর ছেড়ে পাশের জৈনপুরে বেতাই নদীর কূল ঘেঁষে বাড়ি করেন। সাত্তারের পর উকিলের আরও এক ছেলে ও দুই মেয়ের জন্ম। উকিলের অপর ছেলের নাম পুলিশ মিয়া এবং মেয়েদের নাম আয়েশা খাতুন ও রাবিয়া খাতুন। ষাটের দশকের প্রথমদিকে এসে আসরে গান করা ছেড়ে দেন। সেসময়ে এন্ট্রাস পাস স্কুল শিক্ষক ছেলে আব্দুস সাত্তার গায়ক ও কবি হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। তিনি চল্লিশের দশকের শুরু থেকে বাবার সঙ্গে বহু আসরে গান করেন। তিনিও সৈয়দ মোজাফফর আলী (র.) এর মুরিদ হন।
উকিল মুন্সী হাজারেরও অধিক গান লিখেছেন। বর্তমানে বেশির ভাগ গানের সন্ধান পাওয়া যায়না। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি, বন্ধু আমার নিঃদরিয়ার ধন রে, আমি আগে না জানিয়া সখিরে কইরে পিরীতি, আত্বসুখে সুখী যারা প্রেম রতন কি চিনে না, মনের দুঃখ মনে রইল রে, রজনী প্রভাত হলো ডাকে কোকিলা এবং পিরীত ও মধুর পিরীত। তার দুই শতাধিক গান নিয়ে একটি সংকলন সম্পাদনা করেছেন কবি মাহবুব কবির। এছাড়া তাঁকে নিয়ে ওয়াহিদ সুজনের লেখালেখি প্রকাশ হয়েছে ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ নামে।
জগৎ, সংসার আর জীবনের মিশ্র গান লিখে এবং নিজের সুরে নিজের কণ্ঠে গান গেয়ে মানুষের মনে ঠাঁই করে নেন উকিল মুন্সী এবং তা আজও অমলিন। প্রেমের গান, বিরহের গান; যে গানে মানুষের মনে যৌবনের ইহজাগতিক কামনা-বাসনা প্রতিফলিত হয়। অল্প সময়ে বিশাল জলরাশির হাওরাঞ্চলে তার সুর, বাণী ও গায়কী মানুষের মন কেড়ে নেয়। তার গায়কী মানুষকে ব্যাকুল করে তোলে। তিনি হয়ে উঠেন বিখ্যাত বাউল গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক।
যৌবনকালে একতারা আর চটিয়া বাজিয়ে গান গেয়ে মাতিয়েছেন যুবক সমাজকে। গানের শব্দ চয়ন, অপূর্ব উপমা হাওরের মাটির স্রোতধারা, ভালবাসা, প্রেম, বিরহের সার রেখেছেন। খ্যাতি অর্জন করা সেই বাদ্যযন্ত্র আর ঝঙ্কার বন্ধ হলো এক সময়। তিনি শেষ বয়সের হৃদয়স্পর্শী আবেগমাখা বিরহ বিচ্ছেদের গানে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার না করে খালি ভরাট গলায় গেয়েছেন ‘ঘরের মালিকরে দুয়ারে ভিখারী খাড়া তারে বিদায় কর’ ‘আমি কই যাই এই সন্ধাকালে’ ইত্যাদি।
১৯৭৮ সালের মাঝামাঝিতে উকিল মুন্সীর স্ত্রী হামিদা খাতুন এবং কয়েক মাস পর ৬ আগস্ট ছেলে সাত্তার মৃত্যুবরণ করেন। সে বছরই অসুস্থ ববস্থায় উকিল মুন্সী ১২ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার তেতুলিয়া ইউনিয়নের জৈনপুরে বেতাই নদীর পাড়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হন উকিল মুন্সী।
‘ভাগ্য যাহার ভালো নাইওর যাইবে আষাঢ় মাসে উকিলেরই হইবে নাইওর কার্ত্তিক মাসের শেষে রে —’ গানের কথামতো কার্ত্তিক মাসের শেষে মোহনগঞ্জের জৈনপুর গ্রামে ৯৩ বছর বয়সে এই মহান মানুষটি সকলকে কাঁদিয়ে নাইওর গিয়েছেন। তার রচিত সহস্রাধিক গান এখনও তার স্মৃতি ধারণ করে। অতীব মেধাবী, সুন্দর অবয়ব, সংগীত ও ধার্মিক প্রতিভা ও সর্বগুণে কীর্তিমান, বিনয়ী এই মানুষটির মুন্সীয়ানার জন্য মুন্সী উপাধি পেয়ে মানুষের অন্তরে তার সৃষ্টি যুগ যুগ অমলিন থাকবে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর চেয়ারম্যান অব দ্যা বোর্ড অব ডিরেক্টরস ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব জনাব সাজ্জাদুল হাসান‘র উদ্যোগে উকিল মুন্সী স্মৃতিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উকিল মুন্সীর স্মৃতিরা এবং সমাধিস্থল সংরণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে জৈনপুর গ্রামে স্মৃতি সমাধি, ব্রিজ, সড়ক, ভুমি অধিগ্রহণসহ নানা কাজে ২৮ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ ২০২০ থেকে শুরু হয়েছে। এতে একাডেমী ভবন, সমাধিস্থল সংস্কার, সীমানা দেয়াল, সংগ্রহশালা ও উকিল মুন্সী চত্বর নির্মাণাধীন। উকিল মুন্সী বসতবাড়িগামী জৈনপুর আড়াই কিলোমিটার রাস্তা, মরা বেতাই নদীতে ব্রিজ নির্মাণকাজ চলমান। উকিল মুন্সী সমাধিস্থলে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বেতাই নদীতে আরও দুটি ব্রিজ নির্মাণ এবং উকিল বাজার হতে উকিল মুন্সী সমাধিস্থলে সহজে পৌছাতে আরেকটি ব্রিজ নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন। বাউল সাধক কীর্তিমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব উকিল মুন্সীর জন্ম বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা।
মো. আবুল কালাম আজাদ
বিতার্কিক ও সংস্কৃতিকর্মী।
মুঠোফোন : ০১৭১৬ ৩১ ৬০ ৩৩।