সম্প্রতি একটি বিষয় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে যা হলো আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুর্নীতি। গৃহের নিশ্চয়তা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার এবং আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর এ কার্যক্রম শুধু দেশে নয় সারা পৃথিবীতে প্রশংশিত হয়েছে। এমনকি দেশের প্রত্যেকটি মানুষের কাছে বসবাস ও জায়গা পাওয়ার যে অধিকার বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর এ ভূমিকা দল মত সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এখন তাতে কিছুটা কালিমা লেপন হয়েছে দুর্নীতির কারণে।
আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার শ্লোগানে মুজিবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক সারা দেশে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ প্রদান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তথ্য মতে জানা যায় এ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হলো ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠির পুনর্বাসন, ঋণপ্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা, আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি।
সম্প্রতি ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি ১ম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯শ ৪টি এবং ২০ জুন ২য় পর্যায়ে ৫৩ হাজার ৩শ ৪০টি অসহায় পরিবারকে জমি ও গৃহ প্রদান করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৫শ ৬২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
তালিকা অনুযায়ী ক (ভূমি ও গৃহহীন) শ্রেণির পরিবার রয়েছে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩শ ৬১টি এবং খ (১-১০ শতাংশ জমি আছে কিন্তু ঘর নেই বা জরাজীর্ণ) শ্রেণির পরিবার হলো ৫ লাখ ৯২ হাজার ২শ ৬১টি। ২০১৬ সালের তালিকা অনুযায়ী এবং চলতি সময়ে কিছু পরিমাণ সংযুক্তির মাধ্যমে এসব উপকার ভোগীদের তালিকা প্রনয়ণ করা হয়েছে বলে জানা যায়।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটা অত্যন্ত কঠিন একটি বিষয় এবং এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে পাওয়া কঠিন। তাই বলা যেতে পারে এটি একটি রোল মডেল। কিন্তু সমস্যা হলো এসব বাড়ি হস্তান্তরের কয়েকদিন পর থেকে অভিযোগ আসতে থাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘর নির্মাণের অনিয়মের । কোথাও ঘরে ফাটল কিংবা ভিট ঢেবে যাচ্ছে ।
প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প হচ্ছে আশ্রয়ণ প্রকল্প যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর আবেগ ও ভালোবাসা। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। আরো অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। দায়িত্বে অবহেলা বা অনিয়ম পেলেই তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং যাদের বিরুদ্ধে যখনই অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। তা দেখে বুঝা যাচ্ছে এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান অনেক কঠোর।
এ ছাড়াও যাদের ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের আবারও ঘর নির্মাণ করে দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও নকশাবর্হিভূত ঘর নির্মাণ এবং নিন্মমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে সারা দেশের সব জায়গায় কিন্তু এ অভিযোগ একসাথে উঠেনি। তাই এ একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় দেশের বেশির ভাগ জায়গায়ই ভালো মানের ঘর নির্মিত হয়েছে। ঘরের কাঠামো অনুযায়ী ২টি বেড রুম, একটি টয়লেট এবং একটি রান্না ঘরের ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি এসব ঘরকে বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে আলোকিত করে দেওয়া হচ্ছে।
দীর্ঘদিন সমাজের অবহেলিত এ মানুষগুলো এসব ঘর পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে যাচ্ছে। ঘরের উপরে রয়েছে লাল রং এর ঢেউ টিন যা ঘর গুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। ঘর পেয়ে বেঁচে থাকার আশা জেগেছে নতুন করে। এখন আসা যাক গৃহ নির্মাণের প্রক্রিয়াটায়। প্রথম পর্যায়ে এসব ঘরের জন্য ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা বরাদ্ধ থাকলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে এ বরাদ্ধ বৃদ্ধি করে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা করা হয়েছে। তবে এসব ঘর নির্মাণের ব্যয় ও নকশা উপকারভোগীদেরও জানানো প্রয়োজন এবং ঘর নিমার্ণের ব্যাপারে অভিযোগ থাকলে উপকারভোগীরা যেন অভিযোগ দাখিল করতে পারে সে জন্য পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি),উপজেলা প্রকৌশলী, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে এসব ঘর তৈরির জন্য একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা ট্রাস্কফোর্সের মাধ্যমে সত্যিকারের প্রাপ্য ব্যক্তিকে বাছাই করে এ ঘরের জন্য মনোনীত করবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো অভিযোগ থেকে জানা যায় এসব ঘর বরাদ্ধের জন্যও এসব অসহায় গরীব মানুষদের কাছে অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে ঘুষ হিসেবে। আর জমি ও গৃহহীণ মানুষরা একটু সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার আশায় বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার দেনা করে এমনকি এনজিও থেকে ঋণ উত্তোলন করে এসব অর্থ প্রদান করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি ক শ্রেণির ঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে এসব অভিযোগ বেশি পরিলক্ষিত করা যাচ্ছে। ঘরের নকশা দেখে দেখা যায় এসব ঘর নির্মাণ করার সময় বেশ কয়েকটি কাজ যা ঘরকে শক্তিশালী করবে সেসব বিষয়কে বাদ দেওয়া হয়েছে। যার ফলে কয়েকদিন পরই এসব ঘর নিয়ে জটিলতা তৈরি হবে ধারণা করা যাচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ঘরের ছবি থেকে স্পষ্ট হয় যে এসব ঘর নির্মিত হচ্ছে নিচু জায়গায়। যার ফলে অনেক জায়গায়ই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। যেসব ঘর নিচু জায়গায় পানির সাথে রয়েছে সেসব জায়গায় গাইড ওয়াল তৈরির মাধ্যমে ঘরগুলোকে রক্ষা করতে হবে। যেসব খাস জায়গা খুঁজে বের করা হয়েছে তার বেশির ভাগই মানুষের অব্যহৃত জায়গা। এসব জায়গায় মাটি ভরাট করে সাথে সাথে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
যার ফলে অনেক জায়গায় ঘর ঢেবে যাচ্ছে কিছুদিন পরে এ অভিযোগ আরো বৃদ্ধি পাবে। এমনকি এসব মাটি ভরাটের জন্য কোন অর্থ বরাদ্ধ রাখা হয়নি। এছাড়াও ফোর করার সময় সিসি ঢালাই করাটাও ড্রয়িং এ অন্তর্ভূক্ত করা নেই। কেবল মাত্র জানালার উপর লিনটেল ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সারা ঘরের আর কোথাও রডের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। যার ফলে ঘর গুলো বানানোর সময়ই ত্রুটি দেখা যাচ্ছে।
এতে করে ঘরের মানগুলোও ভালো হচ্ছে না যা ভূক্তভোগীদের কাছ থেকে জানা যায়। এটা যেহেতু একটা চলমান প্রক্রিয়া তাই পরবর্তীতে আবার যখন ঘর নির্মাণ শুরু হবে তার আগে এর জন্য আবার নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। কেবলমাত্র কম টাকায় ঘর নির্মাণ করে বাহাবা নিলে হবে না তাতে ক্ষণিক সময়ের জন্য প্রশংসা পেলেও ক্ষতি হবে দীর্ঘস্থায়ী। এতসব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেই ঘর নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এ টাকায় এরকম ঘর নির্মাণ করা সত্যিকার অর্থেই কঠিন ব্যাপার। ইতোমধ্যে আবার অনেকেই এসব বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে বলেও জানা যায়। তবে সারা দেশের সব ঘরই নির্মাণ খারাপ হয়েছে একথা বলা যাবে না। কিছু ঘর খারাপ থাকার কারণে সব ঘর নির্মাণ ত্রুটি হয়েছে বলে বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিদর্শন দল বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন শুরু করেছে এবং মেরামতেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সুন্দর এ সোনালী স্বপ্নটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সব ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি কারন এটি কেবলমাত্র কোন রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিই নয় এটি আধুনিক সোনার বাংলা নির্মাণে একটা স্বপ্ন যাত্রা। এসব ঘর নির্মাণের পর উপকারভোগীরা যেন মানসম্মত জীবন যাত্রায় ফিরে আসতে পারে সেজন্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে এ কার্যক্রমে সংযুক্ত করতে হবে। সমবায়, সমাজসেবা, কৃষি, মৎস্য, প্রাণি ও স্বাস্থ্য বিভাগকে সরাসরি এসব উপকোরভোগীদের দেখভালের দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে।
সরকারের এসব বিভাগের সমন্বয়ের মাধ্যমে এসব উপকারভোগীদের স্বাবলম্বী করে তোলতে হবে। তবে লক্ষণীয় বিষয় যে বিগত সময়ে খ শ্রেণির ঘর নির্মাণের সময় কিন্তু এত পরিমাণ অভিযোগ পাওয়ানি। কারন তখনকার সময়ের ঘরগুলি নির্মাণ হয়েছিল উপকারভোগীদের নিজের জায়গায় এবং বেশিরভাগ ঘরই নির্মাণ হয়েছে শক্ত ভিটের উপর এবং উপকারভোগীরা এসব ঘর নির্মাণের সময় নিজের ঘর বলেই তদারকির সুযোগ পেয়েছে।
এই ক্ষেত্রে বাস্তবায়নকারীরা নিজের ইচ্ছে মতো মানহীণ নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করতে পারেনি। শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও বাংলার ভূমিহীণ মানুষের সুন্দর একটি ঘর ও জায়গা হবে এ প্রত্যাশা সকলের এবং এ ঘর হবে শক্ত কাঠামোর যা হবে দীর্ঘস্থায়ী। কারণ ঘরতো কেবল ঘরই নয় এটি একটি বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
লেখক পরিচিতি
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী
প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ
সভাপতি, ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাব