‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে : কখন আসবে কবি?’ কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর এই কবিতার শেষ ভাগে লিখলেন, ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।’ ‘—- গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি’/ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অতএব তিনিই রাজনীতির কবি তথা পোয়েট অব পলিটিক্স হিসেবে খ্যাত এক মহানায়ক যিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
একটি জাতির ইতিহাস লেখা হবে। পূর্ব আকাশে উদিত হবে স্বাধীনতার লাল সূর্য। পরাধীনতার কারাগার থেকে বেরিয়ে জন্ম হবে একটি স্বাধীন দেশের। কোটি মানুষের দীর্ঘশ্বাস অপেক্ষার অবসান হবে একদিন। হাজার বছরের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের মুক্তির দূত হয়ে এই বসুন্ধরায় আসবেন একজন মহানায়ক। ইতিহাসের কালজয়ী সেই নেতার আবির্ভাবে নিপীড়িত-নির্যাতিত বাঙালি সাহস পাবে ঘুরে দাঁড়ানোর। ঘুমন্তপুরী থেকে জেগে উঠবে নতুন প্রত্যাশায়। আকাশে বাতাসে বেজে উঠবে মুক্তির গান। কিন্তু কে দেখাবেন সেই স্বপ্ন? এই প্রশ্নের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে-বাতাসে! কিন্তু বিশ্ব বিধাতা আমাদের হতাশ করেননি। আমাদের পূর্ব পুরুষদের হাজার বছরের আরাধনার ফসল হিসেবে এই বাঙলায় জন্ম হয়েছিল এক ক্ষণজন্মা পুরুষের। তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ এই ভূখন্ডের তীর্থস্থান, মধুমতির কোলঘেঁষা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় অভিজাত এক মুসলিম পরিবারে জন্ম শতাব্দীর মহানায়কের। ইতিহাসের সেই মহানায়ক ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে সংগঠিত করেন। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্নের জাল বুনতে থাকেন বাঙালি জাতি।
বাঙালি জাতি স্বপ্ন দেখতে পারে-এমনটি বিশ্বাস করেনি ব্রিটিশ থেকে শুরু করে পাকিস্তানের শাসকরা।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো রাজনীতিতেও একজন বংশীবাদকের আবির্ভাব হবে কেউ ভাবেনি। বাংলাদেশে এমন একজন নেতার জন্ম হতে পারে যিনি সংগ্রাম আর ত্যাগের ইতিহাসে নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী, জর্জ ওয়াশিংটন, মার্টিন লুথার কিংকেও ছাড়িয়ে যাবেন। তবে সত্যিই একদিন এ জাতির মুক্তির লক্ষ্যে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন একজন। তিনি রাজনীতির কবি, মানবতার গান গেয়ে যার পথচলা। তিনি বাঙালির একমাত্র অভিভাবক, ইতিহাসের কিংবদন্তি, বিশ্বের বিস্ময় মহান নেতা শেখ মুজিব। পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র কেবল নয়, পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রই হয়তো সেদিন ভাবতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর জাদুমন্ত্রে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম হবে বাংলাদেশ। ক্ষণজন্মা পুরুষ হিসেবে ইতিহাসে যাদের স্থান তারা প্রত্যেকেই আলাদা নিজ নিজ কর্মগুণে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা একটি নাম-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, কেন তিনি ইতিহাসের মহাকাব্য? প্রশ্ন যেকেউ করতেই পারেন, তবে কার এত বড় সাহস যিনি এ নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারেন? বঙ্গবন্ধুই হবেন ইতিহাসের অমর কাব্য-কারণ একমাত্র তিনিই বাঙালির স্বপ্ন পূরণে উৎকর্ষ করেছিলেন নিজেকে। জীবন দিতে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রায় প্রতিটি সদস্যকে। এমনকি নিষ্পাপ শিশু রাসেলকেও। এই বাঙলা, এই দেশ, এ দেশের পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, সৈকত আর বিধৌত পলিমাটি সাক্ষ্য দেয় বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোন নেতাই জাতির স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ। স্বপ্ন দেখিয়েছেন অনেকে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, হাজী শরীয়ত উল্যাসহ অনেক নেতাকেই দেখেছে এই দেশ এই জাতি। রাজনীতিতে হয়তো এসব নেতার বীরত্বগাথা ভূমিকাও রয়েছে কিন্তু ইতিহাসের কিংবদন্তি হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অমর হয়ে আছেন বাঙালির হৃদয়ে। যতদিন বাঙলা থাকবে, বাঙালি থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন বাঙালির মাথার মুকুট হয়ে। লেখক অন্নদাশংকর তাইতো বলেছেন-‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা/গৌরী যমুনা বহমান/ততদিন রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান।’
আমরা কতটাই না পরাধীন ছিলাম? আমাদের মুখের ভাষাও কেড়ে নিতে চেয়েছিল ওরা? আমাদের ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি আর ইতিহাস থাকবেনা, ঐতিহ্য থাকবেনা, আমাদের স্বাধীনতা থাকবেনা, থাকবে শুধু পরাধীনতার গ্লানি? কত বড় দুর্ভাগা ছিল এই জাতি? বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা আমাদের জন্য নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানে মর্যাদার চাকরি আমাদের জন্য নয়, সেনাবাহিনী আর পুলিশ বাহিনীতে আমাদের সন্তানরা চাকুরি পাবেনা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী হতে পারবেনা, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সব দরজা যেন বাঙালির সন্তানদের জন্য চিরতরে বন্ধ- এমন নিষ্ঠুরতা আর অমানবিকতা বাঙালির জীবনে চেপে বসলেও কেউ প্রতিবাদের মশাল জ্বালাতে পারেনি। অদৃশ্য স্বার্থের কাছে হার মানা নেতাদের জাতি দেখেছে বারবার। স্বপ্নের মহানায়ক হিসেবে যখন বঙ্গবন্ধু এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে তখন জাতির একটাই লক্ষ্য, একটাই স্বপ্ন।
বঙ্গবন্ধু তার শৈশব থেকেই নিজেকে তুলে ধরেন স্বপ্নের দূত হিসেবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করেছিলেন তার পক্ষেই সম্ভব স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন। তারপর থেকে প্রতিটি আন্দোলন আর সংগ্রামে বাঙালির মুক্তির দূত হিসেবে আপসহীন নেতৃত্ব দেন তিনি। ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় অভিভূত দেশবাসী স্বাধীনতার গান রচনার স্বপ্ন দেখে। অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর প্রগতির পতাকা হাতে নিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিণত হন জাতীয় রাজনীতির প্রধান নেতা হিসেবে। ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমেই জাতিকে নিয়ে যান স্বাধীনতার স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে। বারবার কারা নির্যাতিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সফল হয় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তারপর বঙ্গবন্ধুর ডাকেই সাড়া দেয় সমগ্র জাতি। শুরু হয় মুক্তির জন্য সংগ্রাম। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর ত্রিশ লাখ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু পরিণত হন বিশ্বনেতায়। কিন্তু রাজনীতির আকাশে ‘ধ্রুবতারা’ এই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল এ দেশরই মীরজাফররা। মাত্র সাড়ে তিন বছরের ক্ষমতায় থাকা বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশকে বানাতে চেয়েছিলেন প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড, কিন্তু পারেননি। চেয়েছিলেন স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে সফল হতে কিন্তু ঘাতকরা সেই সুযোগ দেয়নি।
একজন খোকা থেকে জাতীয় নেতা, জাতীয় নেতা থেকে বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে রাষ্ট্রনায়ক। অতঃপর রাষ্ট্রনায়ক থেকে বিশ্বনন্দিত নেতায় পরিণত হওয়া বঙ্গবন্ধু একটি সংগ্রামী অধ্যায়, একটি সংগ্রামী ইতিহাস, আর সেই ইতিহাস মানেই বাঙালির ইতিহাস। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বনন্দিত কবি সন্দেহ নেই। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী এই কবি যেভাবে বাঙলার রূপ দেখেছেন, কবি জীবনান্দ দাশ যেভাবে বাঙলাকে চিত্রিত করেছেন তার কবিতায়, আমাদের রাজনীতির কবি শেখ মুজিব কী তার চেয়েও গভীর মনোযোগ আর অন্তর দিয়ে দেখেননি এই বাঙলাকে? বাঙলার সাড়ে সাত কোটি অবহেলিত মানুষকে? বঙ্গবন্ধু কি জীবনে একটি বারের জন্যও ভেবেছেন নিজের কথা, নিজের পরিবারের কথা? নিশ্চয়ই না। এই বাঙলাকে ভালোবাসতে গিয়েই সেদিন তো নিষ্ঠুর ঘাতক আর বর্বরদের বুলেটের আঘাতে জীবন দিতে হয়েছে আমাদের প্রিয় নেতাকে। বাঙালি জাতি হারিয়েছে একজন অভিভাবক, একজন রাষ্ট্রনায়ক, একজন আপনজনকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যারা বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তারা কি এদেশের সন্তান দাবী করতে পারে নাকি পাকিস্তানের এজেন্ট? যারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতি করে, ক্ষমতার স্বপ্ন দেখে তার কি স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক নাকি পাকিস্তানের ভাবধারায় বাংলাদেশকে আবার ফিরিয়ে নিতে চায় এমন কোন অশুভ শক্তি? আজ এ বিষয়টি উপলব্দির সময় এসেছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কোটি কোটি মানুষের কাছে আমার সবিনয় জিজ্ঞাসা- যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে হয় তাহলে তার স্বপ্ন পূরণের মাধ্যমেই সত্যিকারের প্রতিশোধ সম্ভব।
বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি তারই যোগ্য সন্তান নন্দিত নেত্রী শেখ হাসিনা আজ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ স¤পন্ন করতে যে লড়াই-সংগ্রাম করছেন সেই স্বুপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণই হবে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ। পাকিস্তানের ভাবধারায় যারা স্বাধীন বাঙলায় রাজনীতি করছেন তাদের চিরতরে বর্জন করাই হবে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে, খুনিদের প্রেতাতœাদের সমাজে এক ঘরে করার উদ্যোগ নেয়াই হবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার নীলনকশা যারা প্রণয়ন করেছিল, নেপথ্যে ইন্ধন জুগিয়েছে তাদের জাতির কাছে ঘৃণিত প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলেই হবে জাতির জনক হত্যার সবচেয়ে বড় প্রতিশোধ।
মো. আবুল কালাম আজাদ
বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতার্কিক,
চেয়ারম্যান,
ময়মনসিংহ ডিবেটিং সোসাইটি, ময়মনসিংহ।