১৫ ও ২১ আগস্ট একই সূত্রে গাঁথা – প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার

প্রকাশিত: ৭:৩৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৫, ২০২১

বাঙ্গালী জাতির জন্য আগস্ট মাসটি বেদনার। আগস্ট এলেই যেন শোকের পাথরটা চাপা পড়ে বুকের উপর। আশা ও আলোর অভিযাত্রী হয়ে বেড়ে উঠা টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেয়া শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি শুধু একজন সুদক্ষ রাজনীতিবিদই নন বরং এমন একজন রাষ্ট্রনেতা যিনি নেতৃত্বের গুণে ছিলেন বলীয়ান।

বাংলার পথে প্রান্তরে এপার থেকে ওপার এমন কোনো স্থান নেই যেখানে তার ছোঁয়া লাগেনি। জাতি বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সকলের ভালোবাসায় তিনি তার নামকে অতিক্রম করে হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এদেশের মানুষকে যেমন স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তেমনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলার মানুষের হারানো অধিকার ফিরিয়ে এনেছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তিনি পেয়েছিলেন কিংবদন্তীর খেতাব। যার নামের শ্লোগানে আজও কাঁপে বাংলা শিহরিত হয় ধমনী। যার নামে পৃথিবীতে পরিচিতি হয়েছিল এ স্বাধীন বাংলা। তিনি ছিলেন বাঙ্গালীর জাতি সত্ত্বার শক্তির উৎস। তাঁর জীবনের যাবতীয় কার্যাবলীই গড়ে উঠেছে এই বাংলাকে নিয়ে। কিন্তু বাঙ্গালী ছাড়াও তিনি কথা বলেছেন গরীব মেহনতি মানুষের অধিকার নিয়ে।

পৃথিবীর বিভিন্ন ফোরামে অবহেলিত মানুষের অধিকার প্রশ্নে তিনি ছিলেন সোচ্চার। নীতি ও আর্দশের প্রতীক হয়ে উঠা বঙ্গবন্ধু মাথা নত করেনি অন্যায় কোনো প্রশ্নে। তাহার মাথা উঁচু হয়েছিল পাহাড়সম। শত প্রতিকূলতার মাঝেও অন্যায়ের প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন। মানুষের জন্য কাজ করাই ছিল যার ধ্যান জ্ঞান ও নেশা। সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করে ধর্ম নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক একটি দেশ হিসেবে গড়ে উঠছিল তখনই নেমে আসে অন্ধকার। উন্নয়নের পথ হয় বাধাগ্রস্থ থেমে যায় সব উন্নয়ন পরিকল্পনা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বাঙ্গালী হারায় তাদের অতি প্রিয়জন রাষ্ট্রনেতাকে। পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যটিও প্রাণ হারায় তাদের হাতে। হত্যাকারীদের মনে ভীতি ছিল হয়তো ছোট্ট শিশুটিই একসময় তাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। সামরিক বাহিনীর কিছু বিপদগামী সদস্য কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে বাঙালীর স্বপ্নকে চরম এক ধাক্কা দেয়। ক্ষমতার লোভ এদের মনে এতটাই ঝেঁকে বসে যে সে থেকে আর বের হয়ে আসতে পারে নাই।

১৫ আগস্টের পর তার নামটি পর্যন্ত মুখে নেওয়ার সাহস পায়নি সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীরা। কিন্তু ভাগ্যলিপি হয়তো এভাবে লেখা ছিল যে হত্যাকারীরা যাদের হত্যা করতে এসেছিল তাদের কাছ থেকে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর তনয়ার হাতেই তাদের বিচার হবে। হত্যাকান্ডের দীর্ঘদিন পর এ বিচারের পথ উন্মুক্ত করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকার। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের মাধ্যমে। তবে এখন পর্যন্ত সকল আসামীকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। শুধু আশার বানীই শুনা যাচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে।

প্রতিবারই আগস্ট মাস এলে এ ব্যাপারে সোচ্চার হয় যারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতো। কয়েকদিন যেতেই থেমে যায় এসব কার্যক্রম। যারা আশার আলোর অপেক্ষোয় জেগে থাকে তাদের মন ভঙ্গ হয় বেদনায়। তবে হ্যাঁ এ কথা না বলার কোন সুযোগ নেই যে মৃত বঙ্গবন্ধু জীবিত

বঙ্গবন্ধুর চেয়ে শক্তিশালী বিভিন্ন ধাপে। বঙ্গবন্ধুর নামের শ্লোগানে এখন কেঁপে উঠে বাংলার রাজপথ। শিহরিত হয় মানুষের ধমনী। ৭ই মার্চের ভাষণে জেগে উঠে কর্মস্পৃহা জেগে উঠে মানুষের প্রাণ। নামটি যেন টনিক হিসেবেই কাজ করে। ঘাতকরা হয়তো ভেবেছিল ১৫ আগস্ট শেষ হয়ে যাবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। কিন্তু তার রক্তের স্রোত যে মিশে গিয়েছিল বাংলার প্রতিটি পথে প্রান্তরে। বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষ প্রতিবাদ মূখর না হলেও অপেক্ষায় ছিলেন জবাব দেওয়ার জন্য। বর্তমান প্রজন্ম জবাব দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে থেকে। যদিও এর জন্য শক্তি সঞ্চার করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘদিন।

২১ বছর পর বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ। এসময়টুকু বাংলা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সকল চেতনা। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি এটা দৃঢ়ভাবে বলা যায়। বর্তমান প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ। প্রধানমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। বলা যায় সফলভাবেই পাচঁ বছর দেশ পরিচালনা করে। আবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা আরোহন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। প্রধানমন্ত্রী হন বেগম খালেদা জিয়া । তখন আবার সক্রিয় হয়ে উঠে সেই ৭১ সালের পরাজিত শক্তি যারা ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকান্ড ঘটিয়ে ছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী।

সারাদেশে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে ঢাকা মহানগর আওয়ামীলীগ ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে তিনটা কুড়ি মিনিটের দিকে মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা করা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই ১২জন এবং পরে হাসপাতালে আরো ১২জন নিহত হন এবং প্রায় তিনশ জন আহত হন। এবছর দেশের ইতিহাসে নারকীয় সেই সন্ত্রাসী হামলার ১২তম বাষিকী। আওয়ামীলীগের নেতারা দেয়াল তৈরি করে রক্ষা করে তাদের প্রিয় নেত্রীকে। স্পিøন্টারের আঘাতে মানুষের হাত-পাসহ বিভিন্ন অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। সভামঞ্চ ট্রাকের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় রক্তাক্ত নিথর দেহ। লাশ আর রক্তে ভেসে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সামনের পিচঢালা পথ। এক ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এ এলাকায় ।

সরকারের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু চিকিৎসাব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠে। গ্রেনেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় বেঁচে যায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। এর পরে এর বিচার নিয়ে চলে প্রহসন। কিন্তু কেন এই প্রহসন কেনইবা জজ মিয়াকে নিয়ে চলে নাটক। যার ফলে মানুষের মাঝে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে চলে অসন্তুষ্টি। যারা আওয়ামীলীগ সমর্থন করে না তারাও এ প্রহসনের পক্ষে যায়নি। সরকার বিচারকে সঠিক পথে নিতে বারবার বাঁধা তৈরি করেছে। যদিও পরবর্তী সময়ে এর বিচার কার্যক্রম আবার শুরু হয়। এখন দুটি বিষয়কে যদি একসাথে মিলানো যায় তবে তবে দেখা যাবে যে দুটি আক্রমের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। কেবল মাত্র রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলই এদুটি হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য নয়।

দেশকে অস্থিতিশীল করা এবং বিভিন্ন সময়ের পরাজয়ের প্রতিশোধ এর অন্যতম কারন হতে পারে। যে কারনই হউক না কেন এটি অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে মুজিব পরিবারই হামলাকারীদের প্রধান টার্গেট। আওয়ামীলীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে হামলাকারীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পথ অলম্বন করেছেন। এ পরিবারকে নিঃশেষ করতে পারলেই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন এই পক্ষরা। কিন্তু হামলাকারীরা একবার তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলেও দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার মেহেরবানীতে বেঁচে যাওয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন একথা আজ সর্বজন স্বীকৃত।

১৫ আগস্ট বেঁচে যাওয়া দুবোন যেন তাদের কাঁটা হয়েই ছিল এবং আছে। তাদের মিশন বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাঁধা । দেশকে বিপথে পরিচালনা এবং নিজ স্বার্থ সিদ্ধিও জন্য হামলাকারী যে পরিকল্পপনা ছিল তা সবটুকু বাস্তবায়ন না হলেও অনেকাংশেই বাস্তাবায়ন হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে। আশার কথা হলো ১৫ আগস্টের বিচার কার্যক্রম সমাপ্ত হয়েছে যদিও সবারই সাজা কার্যকর হয়নি এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যদিও বিএনপি বলছে তাদের নেতাকর্মীদের নাম সরকার এ মামলায় জড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আওয়ামীলীগ বলেছে তদন্তে তাদের নাম এসছে। সকলের প্রত্যাশা সঠিকভাবে বিচার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে পারলে জাতি অভিশাপ মুক্ত হবে।
১৫ আগস্টের ৩২ নম্বরের রক্তের স্রোত যেন প্রবাহিত হয়েছে ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের রাজ পথে। এই দুই স্রোত যে আওয়ামীলীগকে করেছে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ইস্পাত কঠিন। প্রতি বছরই যখন আগস্ট আসে ক্ষতিগ্রস্থ প্রত্যেকটি মানুষ তাদের স্বজন হারানো এবং আহত হওয়ার বিচার দেখতে চায়। দুটি বড় হত্যাকান্ড ছাড়া একই মাসে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একই সাথে দেশের ৬৩টি জেলায় ৫শ স্থানে বোমা হামলা হওয়ার কারনে আগস্ট আজ বাঙ্গালি জাতির কাছে কালো মাস হিসেবে পরিচিত হয়েছে। মোট কথা দল মত নির্বিশেষে দেশে সংগঠিত প্রত্যেকটি হত্যাকান্ডের বিচার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এবং এ ধরনের হত্যাকান্ডের যেন আর না ঘটে তা দেশবাসী দেখতে চায় ।

লেখক পরিচিতি
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী
প্রভাষক ,আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ
সভাপতি, ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাব
ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ