এম উজ্জ্বল, নালিতাবাড়ী, শেরপুর:
আমাদের এই দেশ ছয় ঋতুর বাংলাদেশ। প্রতিটি ঋতুতে তৈরি হয় আলাদা আলাদা উৎসব । বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের বিভিন্ন রকমের খাবার উৎসব আয়োজন। এখন ভাদ্র মাস। তাল পাঁকা গরমে পেঁকেছে তাল। চারদিকে তাল থেকে তৈরি হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের পিঠা।
এম উজ্জ্বল
গন্ধে আর বাহারি নামের, পায়েস, মালপোয়া , তালবড়া ও কেক সহ নানা ধরনের পিঠা তৈরির আমেজ। ভাদ্র মাস এলেই তালের তৈরি এসব পিঠা তৈরি করে গ্রামে গ্রামে তৈরি হত অন্যরকম এক পিঠাউৎসব। নিজেরা খায় এবং আত্বীয় স্বজনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হত। ছোট ছোট বাচ্চারা সকাল হতে না হতেই তালের তৈরি বিভিন্ন স্বাধের পিঠা খেতে মুখিয়ে থাকতো। রাতের অর্ধেক অথবা শেষ রাতে তৈরি করা হয় এসব পিঠা। শুধু তাল নয় এর মাঝে কলা, চিনি, নারিকেল সহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে তৈরি করা হয় তালের পিঠা।
স্বাধে আর গন্ধে পুরো বাড়ি যেন একাকার হয়ে যায়। তাল নিয়ে কথা বলতে গেলে মনে পড়ে ছোটবেলার পড়া ‘কবি খান মুহাম্মদ মইনুদ্দীন’এর সেই কবিতাটি ‘ওই দেখা যায় তালগাছ, ওই আমাদের গাঁ’। ওই খানেতে বাস করে কানা বগির ছাঁ। তবে এখন আর কানা বগির ছাঁ খুব একটা দেখা যায় না। মাঝে মাঝে দেখা মেলে বাবুই পাখির বাসা।
করাত বিশিষ্ট লম্বা ডাগুর ওয়ালা শক্ত ও বড় বড় পাতা হওয়ায় হয়তো এখানেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করে বাবুই পাখি তার বাসা বাঁধে। এই গাছগুলো সাধারণত হয়ে থাকে রাস্তার দুই ধারে, অথবা পুকুর পাড়ে। এবং এগুলো দেখা যায় অনেক দূর থেকে। কারণ এর উচ্চতা হয় অনেক বেশি প্রায় ৬০ থেকে ৮০ ফুট অথবা তারও অধিক। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন,” তালগাছ এক পায়ে দাড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে”। তবে সব গাছেই কিন্তু তাল ধরে না।
পুরুষ তাল গাছ গুলি শুধু রস দেয়। যা দিয়ে লালি, গুড় ,পাটালি তৈরি হয়। যা তালের বিভিন্ন ধরনের পিঠা পায়েস তৈরিতে সহায়তা করে। তালে রয়েছে পুষ্টি ভরা নানা গুণ।
যেমন একটি পাকা তালের প্রতি ১০০ গ্রামে জলীয় অংশ ৭৭ দশমিক ২ গ্রাম, খনিজ শূন্য দশমিক ৭ গ্রাম, আঁশ শূন্য দশমিক ৫ গ্রাম, আমিষ শূন্য দশমিক ৭ গ্রাম, চর্বি শূন্য দশমিক ২ গ্রাম, শর্করা ২০ দশমিক ৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৯ মিলিগ্রাম ও খাদ্যশক্তি ৮৭ কিলোক্যালরি রয়েছে।
যার কারণে এটি শুধু পিঠা উৎসবেরই ফল নয়। বরং বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রতিরোধের একটি ঔষধি ফল। এর দ্বারা বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসা হয়। যেমন অনিদ্রায়, বকবকানি, গনোরিয়া, শ্বেত প্রদরে, রক্ত প্রদরে, অম্লশ্রমে ক্লান্তিতে , অম্ল অজীর্ণ ও পেট ব্যথায়, উদরী রোগে, মূত্ররোধে। এছাড়াও তাল রস তিনটি আশয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে আমাশয়, অগ্নাশয় ও পচ্যমানাশয়ে। এছাড়াও তাল প্রাপ্ত বয়স্ক হবার আগে হয় তালশাঁস যা খুব সুস্বাদু ও সমাদৃত।
বর্তমানে গ্রামে তালের তৈরি এসব বাহারী রকমের পিঠা খুব একটা দেখা যায় না। তবে ঐতিহাসিক এই পিঠা বানাতে কিছু কিছু পরিবার এখনো প্রতিবছর আয়োজন করে থাকে। নিজেরা আয়োজন করে এবং তা আত্মীয় স্বজনের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় এখন তালের তৈরি বিভিন্ন রেসিপি বানিয়ে খেতে দেখা যায়। গ্রামের অনেকেই আবার এসব পিঠা তৈরি করে শহরে থাকা আত্মীয়দের বাসায় নিয়ে যায়। হারানো এই ঐতিহ্য আবার ফিরে আসুক বাংলার ঘরে ঘরে এটাই প্রত্যাশা করছেন অনেকেই।