অগ্রযাত্রায় প্রাথমিক শিক্ষা

প্রকাশিত: ১১:৪৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১১, ২০২৩

মোঃ রিদওয়ানুর রহমান রুবাইয়াৎ :

রসুলপুর গ্রামের বর্গাচাষি বাজিদ মিয়ার তিনসন্তান। বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে তার যৌথ পরিবার। অভাব অনটনের সংসারে খেয়েপরে কোনো রকমে দিন চলে তার। অল্প আয়ের সংসারে সুখের দেখা খুব কমই মেলে, মৌলিক চাহিদাগুলোও ঠিকমতো পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সন্তানেরাও দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু স্কুলে দেয়ার সাহস কুলিয়ে উঠতে পারছেননা বাজিদ মিয়া। তিন বেলা মুখের আহার যেখানে ঠিকমতো জোটেনা, সেখানে গরীবের সন্তানদের পড়াশুনার চিন্তা তার কাছে কষ্ট কল্পনা।

বাজিদ মিয়ার ভুল ভাঙ্গেন রসুলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আলম রেজা। প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারে গ্রামবাসীদের সচেতন করতে গ্রামের স্কুল মাঠে একটি বৈঠকের আয়োজন করেন তিনি। গ্রামবাসীদের অংশগ্রহণে সে বৈঠকে আলম রেজা প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারের গৃহীত নানাবিধ পদক্ষেপ ও সুযোগ সুবিধার কথা তুলে ধরেন। তার বক্তব্যে বাজিদ মিয়াসহ উপস্থিত অভিভাবকেরা সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হন।

প্রাথমিক শিক্ষাস্তর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রথম ধাপ। শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ের এই ধাপকে যত উন্নত ও মজবুত করা যাবে, দেশের শিক্ষাক্ষেত্র ততটাই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হবে; জ্ঞান, মেধা, শিল্পে উন্নত বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে দেশ এগিয়ে যাবে। বর্তমান সরকার দেশের জনগণকে শতভাগ শিক্ষার আওতায় আনতে নানামূখী উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছে। এক্ষেত্রে সরকার কেবল উদ্যোগ গ্রহণ করেই থেমে থাকেনি, বরং উদ্যোগ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত: শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের মধ্য দিয়েই সম্ভব দেশের প্রকৃত উন্নয়ন, স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠন।

১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণকরে ছিলেন। যার ধারাবাহিকতায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার শাসনামলে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ সরকারিকরণ করা হয়েছে। ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নৈশ প্রহরী নিয়োগ করা হয়েছে। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিক্ষার উন্নয়নে সুদূর প্রসারী ভূমিকা পালন করে চলেছে বর্তমান সরকার।

বর্তমান সরকার শিশু শিক্ষার্থীদের আকর্ষণীয় ও উন্নত পাঠদানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। শিক্ষকদের বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত পাঠের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ প্রদানে বর্তমানে দেশে ৬৮টি প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে পিটিআই গুলোতে সার্টিফিকেটইন-এডুকেশন কোর্সের পরিবর্তে ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন কোর্স (ডিপিএড) চালু করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের সকল পিটিআইতে ১৮ মাস মেয়াদি এ কোর্স চালু রয়েছে। শিক্ষকদের সার্বিক মানোন্নয়নে এ কোর্স বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

শিক্ষার ভীত মজবুত করতে বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আকর্ষণীয় ও মনোরম পরিবেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শিশু মনোবিজ্ঞানসহ প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠদানে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ পর্যায়ের শিক্ষকদের শিক্ষাদানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। পূর্বে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অর্ধেকনতুন ও অর্ধেক পুরাতন বই দেয়া হতো। ২০০৯ সাল থেকে প্রাক-প্রাথমিক হতে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নতুন বই বিতরণ করা হচ্ছে। বছরের প্রথম দিন, ১ জানুয়ারি সারাদেশের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছে বর্তমান সরকার।

সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণে অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধকরণে সরকার শতভাগ উপবৃত্তি চাল ুকরেছে। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। দেশের ১০৪টি উপজেলায় শিক্ষার্থীদের মাঝে পুষ্টি সমৃদ্ধ বিস্কুট বিতরণের মাধ্যমে তাদের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা হচ্ছে। নিরাপদ পানীয় ব্যবস্থা নিশ্চিতে বিদ্যালয়গুলোতে গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল শিক্ষায় দক্ষ করে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাল্টিমিডিয়াসহ ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বর্তমান সরকার শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছে। বিদ্যালয় গুলোতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর স্কুল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং ২০১১ সাল থেকে বঙ্গমাতা ফুটবল টুনামেন্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভীত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এসব টুর্নামেন্টের ফলস্বরূপ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ছেলেমেয়েরা দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে।

প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্মান ও জীবন মানের উন্নয়নে সরকার প্রাথমিক শিক্ষকদের পদের গ্রেড বৃদ্ধি করেছে। বর্তমানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণ বিহীন উভয় পর্যায়ের প্রধান শিক্ষকরা ১১তম গ্রেডে এবং সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে বেতন পেয়ে থাকেন। সরকারের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে যা কার্যকর হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সাম্প্রতিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২-এ প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী ৩৭ হাজার ৫শত ৭৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। সরকারের সময়োপযোগী এ সিদ্ধান্ত প্রাথমিক শিক্ষক সংকট সমস্যার অনেকাংশে সমাধান করবে বলে আশা করা যায়। অচিরেই প্রাথমিক পর্যায়ে আরো শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও সরকারের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীন হয়েছিলো। যে স্বপ্ন, যে প্রত্যাশা দেশকে নিয়ে দেশবাসীর হৃদয়ে বর্তমান, সমৃদ্ধির বীজ বপনের মধ্য দিয়ে সে স্বপ্নপূরণে প্রচেষ্টা জরুরি। আর যাদের হাতে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে সেই নবীন প্রজন্মকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। আর শিক্ষিত এক নবীন প্রজন্ম গঠনে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও যথার্থ কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নে দেশের প্রতিটি শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার প্রাধান্য দিয়ে প্রচেষ্টা করে চলেছে। তবে কেবল সরকারের প্রচেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলতে, একটি শিক্ষিত জাতি গঠনে দেশবাসীকেও সচেতন হতে হবে। নিজ সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে শিক্ষিত পরিবার, সমাজ, জাতি গঠনে দেশবাসীকেও সরকারের সহযোগী হতে হবে।

 

লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, ময়মনসিংহ।