নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার
ইতোমধ্যে নির্বাচনের তপসিল ঘোষণা হয়েছে। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নের শেষ হচ্ছে না। এমনিতেই সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনেও দুর্ভাবনার শেষ থাকে তারপর যদি কোন বড় দল অংশগ্রহণ না করে তাহলে সমস্যা আরও বেড়ে যায় নিঃসন্দেহে। কি হচ্ছে ? কি হবে ? হাজারো প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিএনপি কি নির্বাচনে আসবে নাকি বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করবে। যতই দিন ঘনিয়ে আসছে উত্তেজনা যেন ততই বাড়ছে। পাশাপাশি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মাথা ব্যাথার শেষ নেই। যদি বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন হয় তাহলে পরবর্তীতে কি হবে। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপিয় ইউনিয়ন কি করবে পরবর্তীতে ? অনেক প্রশ্নের মাঝেই নির্বাচন কমিশন এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনের দিকে। সময় যতই সামনে আসছে মানুষের মনে ভয় ভীতিও ততই বেড়ে চলছে। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন হওয়ার কথা একটি উৎসব কিন্তু এক পক্ষকে আরেক পক্ষ কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। রাজনীতির প্রধান বিষয়ই হলো মানুষের পাশে থাকা। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদে বসা। জনগণের মন জয় করে ভোট আদায় করা কিন্তু কোথায় যেন এই তালটা হারিয়ে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। চলছে একপক্ষের কথার বানে অন্য পক্ষকে ঘায়েল করার প্রক্রিয়া। কথার প্রক্রিয়াটা ঠিক ছিল কিন্তু চলে এসছে হামলা মামলা। চলছে দেশের ক্ষতি করার নগ্ন কার্যক্রম। কোন দল আবার নিজের কর্তৃত্বের উপর বিশ্বাস হারিয়ে অন্য দেশের কাছে নিজেদের হতাশার কথা ব্যক্ত করে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে দেশের প্রতি ভালোবাসার জায়গাটা ক্ষমতার লোভের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি দলই একবার ক্ষমতায় যাওয়ার পর ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে পুনরায় ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছে জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে। প্রতিবারই নির্বাচন ঘিরে দলগুলোর মাঝে তৈরি হয় বৈরিতা। তৈরি করা হয় ক্ষমতায় যাওয়ার বিভিন্ন কৌশল। আর এইসব কৌশল নিয়ে মাঠে ঝড় তোলা। ইত্যেমধ্যে দেশের প্রধান দুই দলই রয়েছে দুই মেরুতে। সাধারণ মানুষের আশার বিষয়গুলির সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার ব্যাপক ফারাক। সুশীল সমাজও এখন বিভক্ত বলেই মনে হয়। এখন তৈরি হয়েছে দলীয় সুশীল সমাজ। দুদলেরই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী চলছে রাজপথ দখলের। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। দায়িত্বশীলদের মুখের কথা এক। সবাই অবাদ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন চায়। বিরোধী শিবির সরকার পক্ষের উপর আস্থা রাখতে পারছে না অন্যদিকে সরকারি দল সংবিধানের বাইরে যেতে চাচ্ছে না। যথা সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অবিচল সরকার। পৃথিবীর কিছু প্রভাবশালী দেশ এদেশের নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে অনেক বেশি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তাদের নিজের দেশের নির্বাচন নিয়েও তাদের এত মাথা ব্যাথা নেই। এইসব দেশে এমন চাপ প্রয়োগ করছে যে নির্বাচন তাদের কথা মতোই হতে হবে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমঝোতার অভাবেই তৃতীয় পক্ষ এ সুযোগটা নিচ্ছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখাচ্ছে বারবার। এতসব ঝামেলার মাঝেও নির্বাচন কমিশন তাদের নির্বাচনের প্রস্তুতির ঘাটতি রাখছে না। নির্বাচন কমিশন বারবার নিরপেক্ষতার কথা বললেও সেদিকে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছে না বিরোধী দলগুলো। তাদের দাবী এই নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না যদি বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন হয়। অন্যদিকে সংবিধানের আলোকে নির্বাচন করতে বদ্ধ পরিকর বর্তমান সরকার। আজকে যে তত্ত্বাবধায় সরকারের কথা বলা হয়েছে তা নিয়ে জল ঘোলা কম হয়নি। তাই এ বিষয়টি নিয়ে একটু পূর্বে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। বর্তমান মাঠের বিরোধী দল তখনকার সময়ে সরকারি দলে ছিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন সংবিধান যেন সংশোধন না করতে হয়। কিন্তু তখনকার বিরোধী দলের চাপে পড়ে তড়িঘড়ি করে সংবিধান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলনের মাঝেই ১৯ মার্চ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয় এবং ষষ্ঠ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। কিন্তু সারা দেশে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এরপর সরকার ২১ মার্চ তত্ত্ববধায়ক সরকারের বিল সংসদে উত্থাপন করেন। ২৬ মার্চ সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল জাতীয় সংসদে পাস করেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে ৩০ মার্চ রাষ্ট্রপতি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মূল বিষয় হলো দুটি নির্বাচিত সরকারের মধ্যবর্তী সময়কালে সাময়িকভাবে অনির্বাচিত ব্যক্তিবর্গ দেশের শাসনভার গ্রহণ করবেন। যার কাজ হবে দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদন করা।এ সরকার কোনো নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন না এবং শান্তিপূর্ণ সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকার নির্বাচন কমিশনকে সার্বিকভাবে সাহায্য করবেন। কিন্তু ত্তত্বাবধায়ক সরকার এর বাইরে গিয়েও কাজ কর্ম করেছে বিগত সময়ে। এমন কি নিজেদের লোককে সরকারে বসানোর জন্য বিভিন্নভাবে কূটচাল প্রয়োগ করেছে ক্ষমতাসীনরা। যার ফলে পরবর্তী সময়ে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিভিন্নভাবে বিতর্কিত হয়েছে। তাই এ ব্যবস্থাটি বর্তমান সরকারি দলের কাছে আস্থা হারায়। বিরোধী দলে থাকলেই কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুপন্থিতি টের পাওয়া যায়। বলা চলে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধুনালুপ্ত একপ্রকারের শাসন ব্যবস্থা। ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেয়। এছাড়াও বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়। প্রতিবারই নির্বাচনের সময় একটি অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয় এবং শুরু হয় বিদেশীদের দৌঁড়ঝাঁপ। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। চলছে হরতাল অবরোধের মতো সহিংস ঘটনা। সম্পদের ক্ষতির পাশাপশি হচ্ছে প্রাণহানি। অর্থনীতির চাকা চলছে উল্টো পথে। এদিকে কারো তাকানোর সময় নেই যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা প্রয়োজন। মানুষের চাওয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সবাই নিজের পখেই হাঁটছে। সাধারণ মানুষের চাওয়া একটি অবাধ শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। যেখানে সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামীলীগ সরকারে থাকায় মাঠের বড় বিরোধী দল এখন অস্থির হয়ে পড়ছে। বিগত দুটি নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদল সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তাই তারা বর্তমান সরকারের অধীনে আর নির্বাচন করতে ইচ্ছুক না। অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আর ফিরিয়ে আনতে নারাজ বর্তমান সরকার। অন্যদিকে বিদেশীরা চায় বাংলাদেশ সবসময় নিঁচু গলায় কথা বলুক মাথা তুলতে না পারুক। এতসব উন্নয়ন তাদের চোখে জ্বালা ধরেছে। তাই এদেশে শান্তি আসতে দেওয়া যাবে না! মানবাধিকারের নাম করে বিভিন্ন প্রকার নির্যাতন চলছে এদেশের উপর। বড় দেশগুলোতে বারবার মানবাধিকার হরণ করা হলেও অন্য দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে বড় করে দেখা হচ্ছে। এর দায়ভার সবচেয়ে বেশি আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের। তাই এখান থেকে একে অপরের প্রতি আস্থা বাড়িয়ে সংবিধানের আলোকে সুষ্ঠু অবাদ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ খোঁজা উচিত। সকলের প্রত্যাশা মাফিক আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক উৎসব মুখর।
লেখক পরিচিতি
শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক