মতিউর রহমান সেলিম, ত্রিশাল থেকে :
মাঠ ভরা ফসল, গোলা ভরা ধান ছিল কৃষক মন্তাজ আলীর। বছরব্যাপি ধান, পাট ও সবজি চাষ করে কৃষি নির্ভর তিন একর জমির মালিক ওই মন্তাজ আলী চার ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে সুখেই অতিবাহিত করছিলেন দিনগুলো। কোনো অভাব-অনটন ছিলনা তার সংসারে।
১৫ বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে ফিসারি খননের ফলে জলাবদ্ধতায় মন্তাজ আলীর মতো ফসল ফলানো থেকে বঞ্চিত হয় শতাধিক কৃষক। ময়মনসিংহের ত্রিশালের বৈলর ইউনিয়নের পাড় ধানীখোলা গ্রামের সুবিধা বঞ্চিত কৃষকরা স্থানীয় চেয়ারম্যান ও প্রশাসনের কাছে জলাবদ্ধতা নিরসনের সমাধান চেয়ে গত ১৫ বছরে মেলেনি কোন প্রতিকার।
উপজেলা সদর থেকে ১২ মাইল দূরবর্তী বৈলর ইউনিয়নের পাড় ধানীখোলা গ্রামটি। ওই গ্রামে প্রায় একশ একর জায়গা জুড়ে ফালদিগা ও শুক্কুর বিল। বর্ষাকালে ওই দুই বিলে পানি জমলেও পানি নিষ্কাশনে সুগম পথ ছিল বলে কখনো জলাবদ্ধতা দেখা দিত না। পার্শ্ববর্তী গ্রামের কদমতলী ও থলিভাঙা বিল হয়ে ধরার খালে গিয়ে নামত পানি।
মফিজুল ইসলাম ও মোখলেছুর রহমানসহ স্থানীয়রা ফালদিগা ও শুক্কুর বিলের পানি নিষ্কাশনের গতিপথ রোধ করে অপরিকল্পিতভাবে ফিসারির পুকুর খনন করায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
এরপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় শতাধিক কৃষকের বোরো, আমন ধানসহ পাট ও সবজির আবাদ। সুখের সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। কৃষি নির্ভর ওই পরিবারগুলোর সন্তানরা এখন বছরের এক মৌসুমে ইটভাটায় ও বাকি সময়ে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালায়।
জলাবদ্ধতা নিরসনে তৎকালীন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান মুকুলসহ প্রশাসনের সহযোগিতা চান ভোক্তভোগি কৃষকরা।
বছরের পর বছর চলে হস্তক্ষেপ কামনা করে, এরইমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে ১৫ বছর। তবু মেলেনি কোন প্রতিকার। এতে শতাধিক কৃষকের প্রায় একশ একর ফসলি জমি অনাবাদি অবস্থায় পড়ে থাকছে বছরের পর বছর। কৃষকের স্বপ্ন যেন আজ কচুরিপনার নিচে তলিয়ে।
একদিন কুয়াশা ভেদ করে আলো ফুটবে এমন আশায় দিন কাটছে ওই গ্রামের অসহায় কৃষকদের। তবে এবিষয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বেশ কয়েকবার প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে বলে দাবি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার।
এদিকে কৃষকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি ওই এলাকা পরিদর্শন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান ও সহকারি কমিশনা (ভুমি) তরিকুল ইসলাম।
সরেজমিন বৈলর ইউনিয়নের পাড় ধানীখোলা গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, উজান বৈলর গ্রামের মিলন বাজার হতে পাড়ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত রাস্তায় এখনো দৃশ্যমান পানি নিষ্কাশনের জন্য সরকারি অর্থায়নে নির্মিত বক্স কালভার্ট।
যেই দিক দিয়ে আগে ফালদিগা ও শুক্কুর বিলের পানি নিষ্কাশন হতো। এখন ওই বক্স কালভার্টের অগ্রভাগসহ বিলের দুই পাশেই অপরিকল্পিতভাবে ফিসারির পুকুর খনন করে রেখেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
তাতে বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। জলাবদ্ধতার ফলে মৃত আবদুস সালামের মতো বহু বছর আগে গড়ে তোলা বিলপাড়ের অনেক বসতিদের বাড়ির আঙিনা স্যাঁতস্যাঁতে বা পানি জমে থাকে। কৃষকের ঘরে ঘরে এখন কেবল হাহাকার।
বিলপাড়ের বাসিন্দা রুহুল আমিন, মৃত আবদুল হাইয়ের স্ত্রী জরিনা খাতুন ও মৃত আবদুস সালামের স্ত্রী আছিরন নেছাসহ অন্যরা জানান, বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার কারনে রান্না-বান্না ও চলাচলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদেরকে।
আশি বছর বয়সি মন্তাজ আলী বলেন, আমার একমাত্র সম্বল তিন একর জমিই ওই বিলের পানির নিচে। ফিসারি ওয়ালারা পানি যাইবার কোন রাস্তা রাহে নাই। পোলাপান নাতি গুলারে ইটখলায় দিয়া দিছি। ইটখলার কাম বন্ধ ওইলে দিনমজুরের কাম করে।
কারো ভাইগ্যে পড়ালেহা জুডে নাই।
এছাড়াও মোবারক হোসেন মন্ডল, খোরশেদ আলী, শফিকুল ইসলাম, হোসাইন আহমদ, কালু মড়ল, আবদুল মোতালেব, মাখনসহ কৃষকরা জানান, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ করে বিলের দুইপাশেই ফিসারির পুকুর খননের ফলে জলাবদ্ধতা থাকে সারা বছর।
কচুরিপনায় নিমজ্জিত থাকা ওইসব জমিতে ১৫ বছর আগে তারা পুরোদমে বোরো ও আমন ধানের আবাদ ছাড়াও পাট ও সবজির চাষ করত। এখন ওই এলাকার প্রায় একশ একর ফসলি জমি পানির নিচে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে কৃষকরা বছর খানেক আগে বরখাস্ত হওয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান মুকুলসহ প্রশাসনের ধারস্থ হয়েছেন অনেকবার।
যেখান দিয়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় পানি নিষ্কাশনের সুযোগ ছিল, সেখানেও ওই বহিস্কৃত চেয়ারম্যান তার নিজেস্ব লোকের মাধ্যমে দিয়েছেন বাঁধা। তবে তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ অস্বীকার করেন বরখাস্তকৃত ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শোয়েব আহমেদ জানান, ওই সমস্যা নিরসনে এখানকার সাবেক কৃষি কর্মকর্তা খন্দকার মিজানুর রহমানসহ অন্যরাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বেশ কয়েকবার প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি সমাধানে কোন সুরাহা হয়েছে কিনা জানিনা।
এব্যাপারে ইউএনও মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী বোরোর আবাদ নিশ্চিত করণে পানি নিষ্কাশনের জন্য সাময়িকভাবে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে ক্ষতিপূরন দিয়ে পাড়ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন একটি স্থান নির্ধারন করেছিলাম। কিন্তু বরখাস্তকৃত মুকুল চেয়ারম্যানের কারনে তা বাঁধাগ্রস্থ হয়। তবে আমরা থেমে নেই, বিশাল পরিমানের ওইসব জমিতে ফসল আবাদের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাব।