কলিহাসান, দুর্গাপুর (নেত্রকোনা)প্রতিনিধি :
দশম শ্রেণির স্কুলছাত্রীকে একাধিকবার ধর্ষণ ঘটনা ধামাচাপা দিতে গ্রাম্য সালিসে ওই কিশোরীর প্রাপ্ত বয়সে বিয়ের আশ্বাসে আপোষ-মিমাংসা নামে দফা-রফা’র ৪৫হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রুহু’র বিরুদ্ধে।
অভিযুক্ত ধর্ষক বাকলজোড়া ইউনিয়নের রামনগর(কাগজুর)গ্রামের আলতু মিয়ার ছেলে শাকিব(২২)। বিরিশিরি ইউনিয়নের খালশাপাড়া গ্রামে এ ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে। ওই ভিকটিম কিশোরী স্থানীয় একটি হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল বলে জানা গেছে। গ্রাম্য সালিসের বিয়ের সিদ্ধান্তে কিশোরী’র ১৮ বছর পূর্ণ হলেও এখন বিয়ে নিতে নারাজ অভিযুক্ত ও তার পরিবার। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী কিশোরী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন।
ধর্ষকের পরিবার গ্রাম্য সালিসেই বিয়ের কার্য সম্পন্ন করতে ৪৫হাজার টাকা জমা রাখেন ইউপি চেয়ারম্যান এর নিকট বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মাতব্বর ও ভুক্তভোগীর পরিবার। ওই ধর্ষণের ঘটনার পরদিন ইউপি চেয়ারম্যান তার নিজ বাড়িতেই সালিস বসান।
ধর্ষণের বিচার না পেয়ে ভুক্তভোগী কিশোরীর মা শিক্ষার্থীকে নিয়ে বিপাকে পড়ে এখন অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন বলে সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্রই চোখে পড়ে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান,সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য ও গ্রাম্য মাতাব্বরদের কাছ থেকে প্রতারণার শিকার হয়ে স্কুলছাত্রীর পরিবার ও এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র চাপা ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।
ভুক্তভোগী কিশোরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মান গেল, ইজ্জত হারালাম, সমাজে বিচারও পাইনি। সমাজে মুখ দেখাতে পারছিনা। এখন আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো উপায় পাচ্ছি না। আমার উপর যে জুলুম করা হয়েছে, এমন জুলুম যেনো আর কোন শিক্ষার্থীর উপর করা না হয়। এমন সব আবেগঘন কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থী আরো জানান, বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে বাকলজোড়া ইউনিয়নের রামনগর (কাকজোড়) গ্রামের আলতু মিয়ার ছেলে সাকিব প্রায়ই তাকে উত্ত্যক্ত করত। একদিন স্কুল থেকে একাকী আসার পথে গুজিরকোণা বেলগাছতলা নামক জায়গায় তাকে একা পেয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। ওই শিক্ষার্থীর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ও স্কুলের দেয়ালে পোস্টারিং করে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয়-ভীতি দেখিয়ে আরো বিভিন্ন জায়গায় একাধিকবার ধর্ষণ করে শাকিব। বিগত ২০১৯খ্রি. সনের ১২ জুলাই শিক্ষার্থীর বাড়িতে এসে পুণরায় ধর্ষণের চেস্টা চালালে প্রতিবেশী আব্দুল কাদির মিয়ার ছেলে শাহীন মিয়া বিষয়টি টের পেয়ে আশ-পাশের লোকজন জড়ো হলে ধর্ষক সাকিব ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
পরদিন বিষয়টি জানাজানি হলে চেয়ারম্যান ও গ্রাম্য মাতবরগণ সাকিবের প্রভাবশালী ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে সালিস ডেকে বিষয়টি ৪৫ হাজার টাকায় ধামাচাপা দেওয়ার চেস্টা করেন। প্রাপ্ত বয়সে বিয়ের আনুষ্ঠানিক খরচের আশ^াসে ওই টাকা ইউপি চেয়ারম্যান নিজ জিম্মায় রেখে দেন। আজ তিন বছর পেরিয়ে গেলেও বিয়ের তারিখ নির্ধারণ ও ওই টাকার কোন হদিস পাচ্ছেন না। পরে চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রুহু ওই টাকা আত্মসাত করেছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী পরিবারের।
ভুক্তভোগীর বাবা কেঁদে বলেন, আমার মেয়ের উপর যে অবিচার করা হয়েছে আমি এর বিচার চাই। অপপ্রচারকারীদের কারণে আমি মাঠে, ঘাটে, বাজারে কোথাও যেতে পারি না, মুখ দেখাতে পারি না। আমার মেয়েকে এখন কেউ বিয়ে করবে না। এমন জঘন্য প্রতারণা না করে আমার পরিবারের সবাইকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেললেও পারতো। ভুক্তভোগীর চাচাতো ভাই বলেছেন, মামলা করার পর থেকে বেশ কয়েকবার তারা হুমকি-ধমকির শিকার হয়েছেন। এমনকি কিছুদিন আগেও ভাড়াটে গুন্ডা ও কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার হয়েছেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর দাবি, দুর্গাপুর থানার উপপরিদর্শক ও ওই ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা বিট অফিসার মো. সাদেক ধর্ষণের ঘটনার অভিযুক্ত আসামী সাকিবকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেছে। তবে কিশোরীকে জোরপূর্বক থানা নিয়ে ধর্ষণের মেডিকেল টেস্ট করানোর অভিযোগ উঠেছে উপপরিদর্শক সাদেক এর বিরুদ্ধে। আদালতের মাধ্যমে ভিকটিমের কোন জবানবন্দি নেননি। তিনি ধর্ষকের পরিবারের সাথে একাত্ত্বতা পোষণ করে আমার সাথে অবিচার করেছেন। আমার পরিবার অত্যন্ত দরিদ্র ও অশিতি হওয়ায় মামলা পরিচালনার পদে পদে বাধাগ্রস্থ হতে হচ্ছে।
প্রতিবেশী গ্রাম্য মাতব্বর রঞ্জিত কুমার চন্দ বলেন, স্কুল পড়–য়া শিক্ষার্থীর সাথে অন্যায় করা হয়েছে। অসংখ্য মানুষের সামনে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখন প্রতারণা করাটা খুবই খারাপ কাজ। তিনিও সালিসে উপস্থিত ছিলেন।
এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি মেম্বার আব্দুল লতিফ বলেন, আমি চেয়ারম্যান বাড়িতে অনুষ্ঠিত সালিসে ছিলাম। মেয়েটির বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলে সাকিবের সাথে বিয়ের দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখন শুনছি ছেলে পরিবার এ বিয়ের বিষয়টি মেনে নিবে না। ভুক্তভোগী মেয়েটি সুবিচার পাক।
ধর্ষণের ঘটনায় মামলার পর থেকে অভিযুক্ত সাবিক পলাতক রয়েছে। অভিযুক্তের পিতা আলতু মিয়া বলেন, ওই সালিসে বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করতে স্থানীয় চেয়ারম্যান রুহু’র নিকট ৪৫ হাজার টাকা জমা রাখি। যেহেতু মেয়ের বয়স ১৬বছর, কোনভাবে বিয়ে করানো যাবেনা। তখন ওই টাকাটা ফেরত আনতে দুই বছর উনারা কাছে গেলেও তিনি ওই টাকা দেননি। সম্প্রতি ওই টাকা আত্মসাত এর বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে চেয়ারম্যান খবর দিয়ে বিশ হাজার টাকা ফেরত দেন। বাকী ২৫ হাজার টাকা তিনি দিবেন না বলে সাফ বলে দেন।
এ ব্যাপারে গ্রাম্য সালিসের বিচারক ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রুহু বলেন, ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে আমার বাড়িতেই সালিস বসে। শিক্ষার্থীর বয়স হয়নি বিবেচনায় প্রাপ্ত বয়সে তাদের বিয়ে দেওয়া হবে। আনুষ্ঠানিক খরচ ৪৫ হাজার টাকা আমার কাছে রেখে যান ছেলে পক্ষ। পরে শুনলাম মেয়ের পরিবার মামলা করেছে। তখন ছেলের পরিবারের হাতে তাঁদের দেয়া টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। আর আমি ওই টাকা আত্মসাত করতে যাবো কেন। ধর্ষণ ঘটনা গ্রাম্য সালিসে বিচার করার এখতিয়ার স্থানীয় চেয়ারম্যান এর আছে কিনা এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এ বিষয়টি আর কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেণ।
দুর্গাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) শাহনুর এ আলম শিক্ষার্থী ধর্ষণ ঘটনার বিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি নিয়ে স্থানীয় চেয়রাম্যান গ্রাম্য সালিস বসান। সেটি কোনভাবেই ঠিক নয়। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীর পরিবার আদালতে মামলা দায়ের করে। আদালতের নির্দেশে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার পূর্বক জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।