মতিউর রহমান সেলিম, ত্রিশাল (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
দুবছর বয়সে রিফাতের মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। রিফাতের জীবনে সৎমা এলেও দাদীর ভালবাসা আর সেবা-যতেœ বেড়ে উঠে সে। এইচএসসিও পাস করার পর রিফাতকে বিদেশ নিতে প্রবাসি বাবা তার পাসপোর্ট করান। স্বামীর টাকা নষ্ট করে সৎছেলে বিদেশ যাবে এটা হয়তো মেনে নিতে পারেননি রিফাতের সৎমা। আকেঁন ষড়যন্তের ফাঁদ। সৎ মায়ের ষড়যন্তে ‘পাগল বানিয়ে’ শিকলে বন্দী হয় রিফাত। পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় কাটলো তার তিন বছর। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহের ত্রিশালের হরিরামপুর ইউনিয়নের হরিরামপুর গ্রামে।
স্থানীয় এলাকাবাসি ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের হরিরামপুর গ্রামের ইদ্রিস আলী ১৯৯৫ সালে পরিবারের অমতে প্রেম করে বিয়ে করেন একই গ্রামের বেদেনা খাতুনকে। ওই বছরের শেষের দিকে কুয়েতে পাড়ি জমান ইদ্রিস। আর ১৯৯৬ সালে ওই প্রেমিকযুগলের ঘরে জন্মগ্রহন করেন রিফাত। রিফাতের বয়স যখন দুইবছর তখন তার মা বেদেনাকে বিভিন্ন অভিযোগে বিদেশ থেকেই তালাক দেন বাবা ইদ্রিস আলী। তালাকের বছর পাঁচেক পরে দেশে ফিরে আবারও বিয়ে করেন ইদ্রিস।
রিফাতের কিশোর জীবনে আসে সৎমা। সৎমায়ের কবল থেকে রক্ষা করতে রিফাতের ভরণপোষনের দায়িত্ব নেন তার দাদী। দাদীর ভালবাসা আর সেবা-যতেœ বেড়ে উঠে সে। দাদীর তত্বাবধানে থেকে ২০১২ সালে এসএসসি এবং ২০১৪ সালে এইচএসসি পাস করে রিফাত। এইচএসসি পাস করার পরপরই ছেলেকে বিদেশ নেয়ার জন্য ইদ্রিস আলী রিফাতের পাসপোর্ট করান। রিফাতকে বিদেশে নেয়ার বিষয়টিই তার জীবনে কাল হয়ে দাড়ায়।
এমন সিদ্ধান্তে স্বামীকে সরাসরি বাঁধা নিতে না পারলেও, স্বামীর টাকা নষ্ট করে সৎছেলে বিদেশ যাবে এটা হয়তো মেনে নিতে পারেননি রিফাতের সৎমা মর্জিনা খাতুন। আকেঁন ষড়যন্তের ফাঁদ। পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার কিছুদিন পর সৎমা মর্জিনা খাতুন শাশুড়িকে ম্যানেজ করে রিফাতকে নিয়ে যান তার বাপেরবাড়ি। সেখানে তাকে কি খাওয়ানো হয় জানা নেই কারো। তবে ওখান থেকে ফেরার পর মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে আবোল-তাবল কথা বলতে শুরু করে রিফাত। চিকিৎসার জন্য রিফাতের দাদী তাকে বিভিন্ন চিকিৎসক আর কবিরাজ দেখান। তাতে সাময়িকের জন্য কিছুটা সুস্থতাবোধ করলেও ৯ বছর ধরে মাঝেমধ্যেই পাগলের মত আচরনের লক্ষণ দেখা দেয় তারমাঝে। আর তাতেই শিকলে বন্দী হয় রিফাত। পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় কাটছে তার জীবনের তিনটি বছর।
সরেজমিন রিফাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের অন্য সদস্যরা দালানকোঠার ঘরে খাট-সোফায় আরাম আয়েশে জীবন কাটালেও পায়ে শিকল বেঁধে খুঁটির সঙ্গে আটকানো রিফাতকে রাখা হয়েছে বাড়ির বাইরের একটি গোয়ালঘরে। মশারি বিহীন একটি চৌকিতে শুয়ে আছে সে। চৌকিটির পাশেই শিকলের দুরত্বে সৌচাগারের ব্যবস্থা।
নাম ধরে ডাক দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসে রিফাত। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে সে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর স্পষ্টভাবেই দেয় রিফাত। একটা সুস্থ ছেলেকে কেন এভাবে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছেন এমন প্রশ্নে, শিকল থেকে রিফাতকে মুক্ত করে দেন তার বাবা। সৎমা মর্জিনা খাতুনকে সেখানে ডাকা হলে তিনি বলেন, আমি যাব না, সেখানে গেলে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করবে রিফাত। অথচ ওই বাড়িতে ঘন্টা দেড় অবস্থান করে দেখা যায়, বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে সে তার সৎমাকে সালাম দিয়ে, কথা মত বাথরুমে ঢুকে গোসল সেরে নামাজ পড়তে যায় রিফাত। নামাজ শেষে বাড়ি এসে খাবার খেতে বসে। যদিও তিন বছর পর শিকল থেকে মুক্ত রিফাতের পাশে বসে খাবার খেতে সহযোগিতা করেনি তার সৎমা।
সত্যিকার অর্থেই কি রিফাত সুস্থ হয়ে উঠেছে নাকি সৎমায়ের জ্বালা আর অত্যাচারে এমন অস্বাভাবিক আচরন করছে সে, এবিষয়ে জানতে কথা হয় তার বাবা ইদ্রিস আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, রিফাতের অসুস্থতার খবর পেয়ে দেশে চলে আসি। দেশে আসার পর অনেকের মুখে অনেক কথাই শুনেছি। সৎমায়ের ঘর বলে কথা। নিরুপায় হয়ে অনেককিছু সহ্য করতে হয়েছে আমাকে। তবু ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছি। পুরোপুরি সুস্থ হলো কি-না তা বুঝতে পারছি না।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে স্থানীয়রা জানান, সৎ মায়ের যন্ত্রনাময় কথাবার্তা এবং অশোভন আচরন আর কার্যকলাপের কারনে ৯ বছর ধরে রিফাতের অস্বাভাবিক আচরন ও আজকের এই অবস্থা। স্থানীয়রা মনে করেন, সৌহাদ্যপূর্ণ ব্যবহার পেলে তার অস্বাভাবিক আচরনের পরিবর্তন ঘটবে।