মো. আবুল কালাম আজাদ :
‘আমার কোন চাওয়া-পাওয়া নেই, মানুষের ডাকে সাড়া না দিলে মানুষ কষ্ট পায়। তাই বিরক্ত হলেও মানুষকে কষ্ট দিইনা। রান্না-বান্নার কাজ করে আনন্দ পাই, মানুষের ভালোবাসা পাই অনেক। তাই, যতদিন মাটির উপর আছি ততোদিন কাজ করে যেতে চাই।’ বলছিলেন সরলমনা বাবুর্চি, যিনি সাধারণ হয়েও অসাধারণ মো. মাজু মিয়া ওরফে মাজু বাবুর্চি। মাজু মিয়ার বর্তমান বয়স ৬৫। রান্না-বান্নার কাজ করছেন প্রায় ৩৮ বছর ধরে। এ কাজে তার কোন চাহিদা বা চাওয়া নেই। মানুষ খুশি হয়ে যা দেয় তাতেই তিনি সন্তুষ্ট। তার পরেও এ কাজ করে বছরে তিনি প্রায় লক্ষাধিক টাকা পেয়ে থাকেন।
মো. মাজু মিয়া ওরফে মাজু বাবুর্চি একসময় যাত্রাদলে জুকার অভিনেতা হিসেবে কাজ করতেন। নবরঞ্জন যাত্রাদলে তিনি ৯ বছর কাজ করে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন অনেক। গ্রামের ঝুমুর যাত্রাপালায়ও অভিনয় করেছেন অনেকবার। এখন তিনি গ্রামের বাড়িতেই পরিবার আর নাতি-নাতনিদের সাথে বসবাস করছেন। মাজু মিয়ার বাড়ী মোহনগঞ্জ উপজেলার ৫ নং সমাজ-সহিলদেও ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের শাঁকরাজ গ্রামে। বিয়ে করেছেন প্রায় ৪০ বছর হয়েছে। তিনি তার স্ত্রীসহ দুই ছেলে আর তিন মেয়ের অভিভাবকত্ব নিয়ে স্বাচ্ছন্দে দিনাতিপাত করছেন। মাজু বাবুর্চি রান্না-বান্না ছাড়াও কৃষি কাজও করেন। বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়াও সকল প্রকার অনুষ্ঠানে রান্নার কাজ করে সফলতার সাক্ষর রেখে চলেছেন। বিয়েসহ যেকোনো অনুষ্ঠানে তিনি পোলাও, গরু-মুরগী এবং খাসীর মাংস, রোস্ট, কাবাব, কোরমা, জর্দা, বোরহানি, কুপ্তা, পায়েস ছাড়াও যেকোনো মুখরোচক রান্নায় তিনি সিদ্ধহস্ত। বাবুর্চি হিসেবে উপজেলার গন্ডি ছাড়িয়ে জেলা এবং বিভাগীয় পরিসরেও পরিচিতি ও সুনাম রয়েছে মাজু মিয়ার।
মাজু মিয়া ওরফে মাজু বাবুর্চির ওস্তাদ নবাবগঞ্জের ছত্তার বাবুর্চি। ছত্তার বাবুর্চির তালিম এবং বিভিন্ন কো¤পানির প্রাপ্ত বই থেকে তিনি দীক্ষা নিয়ে আজকের মাজু বাবুর্চি খ্যাতি পেয়েছেন। ৩৮ বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি নিজেই এখন আপাদমস্তক বাবুর্চি হিসেবে পরিপক্ব। মাজু মিয়া বলেন, সারাদিন রান্নার কাজে আমার কোন ক্লান্তি নেই, নেই কোন অভিযোগও। কেননা, মানুষের ভালোবাসা আমার সকল কষ্ট-ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। দিনশেষে মানুষ যা দেয় তাতেই আমি খুশি। মানুষের ভালোবাসাই আমার কাছে অনেক কিছু।
সম্প্রতি মোহনগঞ্জ উপজেলার রামজীবনপুর গ্রামে শাহজাহান কবিরের বৌ-ভাত অনুষ্ঠানে ৫ শত অতিথির রান্নার কাজে তার সাথে লেখকের দেখা হয়েছে এবং কথা হয়েছে। উক্ত আয়োজনে দেখা গেছে দিনব্যাপী রান্নার কাজে তিনি স্বতঃস্ফূর্ত। সবসময় হাসিমুখ ধরে রাখছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সকলের সাথে গল্পে মজে আছেন। তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, তিনি মানুষের ডাকে কখনো বিরক্ত না হয়ে ৩৮ বছর ধরে রান্নার কাজ করে চলেছেন বিরামহীন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রশ্নে তিনি বলেন, যতদিন মাটির উপর আছি ততোদিন কাজ করতে চাই। তিনি বলেন, রান্না ছাড়াও পরিবারকে সময় দেয়া, ঘর-গৃহস্থালির কাজ, কৃষি কাজ করে সময় কাটাই। সময়মত নামাজ-কালাম পড়ি।
৬৫ বছর পরে জীবনের এই বেলায় আপনার কী চাওয়ার আছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার কিছুই চাওয়ার নেই, পাওয়ারও নেই। আমি ক্ষুদ্র, অতি সামান্য মানুষ। জীবনে কারো ক্ষতি করিনি, ক্ষতির চিন্তাও করিনি, আমারও কেউ ক্ষতি করেনি। ইজ্জত আর ঈমানের সাথে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারলেই আমার শান্তি।
বেলা শেষ হয়ে আসে। মাজু মিয়ার এবার বিদায়ের পালা। শাহজাহান কবিরের চাচা আব্দুল হাসিদ যখন তাকে সম্মানী দিচ্ছিলেন তখন হাসিমুখে তিনি তা পকেটে রাখেন। ক্লেদ, ক্লান্তি ভুলে মুগ্ধতা ছড়িয়ে হাসিমুখে মাজু মিয়া বাড়ির দিকে পা বাড়ান। নীরবে চলে যান তার নিজ ঠিকানায়। সত্যিই আমরা জীবনের পিছনে চাওয়া পাওয়ার আধিক্যতায় যখন মগ্ন তখন মাজু মিয়ার মত মানুষেরা আমাদেরকে শিখিয়ে দেয় যে, শুধু অর্থ-বিত্ত-প্রতিপত্তিই সবকিছু নয়। মানুষের ভালোবাসাই মানুষের কাছে বিশেষ কিছু। এমন মাজু মিয়া আমাদের সমাজে অনেক রয়েছেন অথচ আমরা জানিনা, জানবার প্রয়োজনও বোধ করিনা। সত্যিই মাজু মিয়াদের কাছে আমাদের শিখবার আছে অনেক কিছুই, জীবনের প্রশ্নে, জ্ঞানের প্রশ্নে-বেঁচে থাকার প্রশ্নে। মাজু মিয়ারা বেঁচে থাকুক মানুষের ভালবাসায়-শ্রদ্ধায়-সম্মানে।
মো. আবুল কালাম আজাদ
সাবেক বিতার্কিক, বাংলাদেশ টেলিভিশন।
লেখক, গবেষক।