প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার
ছোট দেশ। প্রচুর মানুষ। চাহিদা বেশি। প্রাপ্তি কম। নেই এর পাল্লা ভারী। ফলাফল হতাশা। এত সব চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভালো থাকা ! এ যেন কেবলই বেঁচে থাকা। সারা পৃথিবীর ন্যায় আমাদের বাংলাদেশও আক্রান্ত করোনায়। বির্পযস্ত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। দেশের মানুষ অনেকটাই নির্ভার হয়েই গিয়েছিল হয়তো মুক্তি মিলেছে করোনা থেকে। কিন্তু এর মধ্যেই শুরু হয়েছে আবার করোনার ভয়াবহতা। যে লকডাউন শব্দটি মানুষের মুখ থেকে চলে যাচ্ছিল সেটি আবার আবার চলে এলো জটিল আকারে।
এ পরিস্থিতিতে জীবনকে চালিয়ে নেয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম করতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষদের। যাদের দুবেলা খাবার জোগাড় করার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শ্রম বিনিয়োগ করতে হবে। এ শ্রমের অর্থে চুলায় খাবারের হাঁড়ি বসে। গত বছর করোনা শুরুর সময় থেকে মানুষের যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল তার চেয়ে এবছর আরো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বিশেষজ্ঞদের মতে।
সরকারের পক্ষ থেকে আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। বিভিন্ন কারণে ইচ্ছে করলেই প্রয়োজন মতো লকডাউন দেওয়া সম্ভভপর হয় না সরকারের পক্ষে এ কথা অনেকের পক্ষেই বুঝা কঠিন। মানুষের জীবন বাঁচানো যেমন চ্যালেঞ্জ তেমনি খেয়ে পড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখাও সরকারের একটা দায়বদ্ধতা। উচ্চ আয়ের মানুষ যেমন স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে ঠিক তেমনি নিম্ন আয়ের মানুষও সরকারের মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা ঘোষণা করেছে। এই ১৮ দফা নির্দেশনা কিছু অংশ মেনে চলছে জীবন সংগ্রাম। একদিকে পেটের চিন্তা অন্যদিকে বেঁচে থাকা। দুটোর মধ্যে সেতু তৈরি করতেই মূলত এ নির্দেশনা।
যেসব নির্দেশা প্রদান করা হয়েছে সত্যিকার অর্থেই সকল নির্দেশনা বাস্তবায়ত করা গেলে অবশ্যই করোনা থেকে আমরা দুরে থাকতে পারবো এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে এতে মানুষের স্বাভাবিক কর্মজীবনে ব্যাঘাত ঘটবে এটা অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের চিন্তা অনেকটাই বেশি। কারন স্বাভাবিক কাজ কর্ম বন্ধ থাকলে তাদেরই বেশি ক্ষতি। এসব খেটে খাওয়া মানুষের প্রয়োজনীয় অভাব থেকে মুক্ত রেখে দীর্ঘদিন চালিয়ে নেওয়া সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয়। আবার আরেকটি বিষয়ের দিকে নজর দিলে দেখা যায় যে শহর এবং গ্রামের লক ডাউনের চিত্র ভিন্ন । এ যেন ভিন্ন দেশ ভিন্ন মানুষ ভিন্ন দর্শন। গ্রামের ক্ষেত্রে যেন করোনার সংজ্ঞাই পাল্টে যায়।
সচেতনতার বালাই নেই গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থায়। ইতোমধ্যে দেশের প্রতিটি উপজেলায় মাঠ প্রশাসন লকডাউন কার্যকর করার লক্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু এসব প্রস্তুতি দিয়েই কি জীবনযাত্রা লক করা সম্ভব। জীবন বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে ঘর থেকে বের হয়ে আসছে মানুষ। আবার অপ্রয়োজনেও মানুষ বাহির মুখি। কর্মের দিকে ধাবিত হচ্ছে অর্থের সন্ধ্যানে। সরকারের যেসব প্রস্তুতি মাঠ পর্যায়ে রয়েছে তাতো অনেকটাই আইন মানতে বাধ্য করার প্রস্তুতি।
আমাদের দেশের মানুষ আইন ভাঙ্গতেই পছন্দ করেন বেশি। অনেক ক্ষেত্রে আইন না মানাটা সমাজের মানুষের একটা অংশ ক্রেডিট মনে করেন। এই অবস্থায় সরকারের মানুষকে ঘরে রাখার পলিসি কতটা কার্যকর করতে পারবে সেটা ভেবে দেখার বিষয়। তথাপি ভেবেচিন্তে মানুষের কল্যাণে আইন প্রয়োগ ঘটানো জরুরি। যেদিন লকডাউন ঘোষণা করা হলো সেদিন থেকেই দল বেঁধে মানুষ শহর ছাড়তে শুরু করেছে। এসব বিধি কার্যকর করার জন্য মানুষকে কিছু দিন নিজ নিজ অবস্থানে রাখাই শ্রেয় ছিল। কিন্তু শহর ব্যবস্থায় জীবনকে ধরে রাখতে হলে কর্মের বিকল্প নেই।
গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থা থেকে শহরের জীবন ব্যবস্থা অনেক ব্যয়বহুল এবং বেশি যান্ত্রিক। ইতোমধ্যে সারাদেশে লকডাউন বিরোধী আন্দোলনও দানা বেঁধে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের দাবী রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলে দেওয়ার জন্য। গত বছরও করোনার কারণে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয়। তবে এবারের লকডাউন আর বিগত বছরের লকডাউনের মধ্যে সরকার অনেকটাই পার্থক্য রেখেছে এটা সকলকে অনুধাবন করতে হবে।
এটাকে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর বিধি নিষেধ নামেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। অবশ্য বিষেজ্ঞরা বলছে এ লকডাউন করোনা প্রতিরোধে বাস্তব সম্মত কোন ভূমিকা নয়। প্রশাসনের লোকজন জনগণকে সম্পৃক্ত করে মাঠ পর্যায়ে লকডাউন বাস্তবায়ন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে করেও খুব একটা সুফল আসছে বলে মনে হয় না।
সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনায় যেসব বিধিমালা আরোপ করা হয়েছে এর মধ্যে অনেক ফাঁক রাখা হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। সরকারের চিন্তা হয়তো মানুষকে খেয়ে পড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখা। অনেক জায়গায় কঠোর বিধি নিষেধ দেখাতে প্রশাসনকে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে বলে জানা যায়। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় সরকার এসব বিধি নিষেধ বাস্তবায়নে অনেকটাই নমনীয়। ইতোমধ্যে সকল সিটি কর্পোরেশনে গণ পরিবহন চলার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এ
মনিকি বিধি নিষেধ থাকলেও শহর থেকে গ্রাম পর্যন্তু সিএনজি অটো রিক্সা চলছে নিয়মিত। মানুষ বের হয়ে আসছে ঘর থেকে। কেবলমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় লকডাউনের বিধি নিষেধ দৃশ্যমান। মোট কথা হচ্ছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ এখনও বুঝে উঠতে পারে নাই করোনার ভয়াবহতা।
করোনার করুন অবস্থা মনের মধ্যে প্রবেশ না করলে আইন প্রযোগ করা সম্ভব নয়। উপজেলা পর্যায়ের বাজারে লকডাউনের কিছু চিত্র দেখা গেলেও গ্রাম পর্যায়ের বাজারগুলোতে অবস্থা ভয়াবহ। মানুষ বসবাসের ঘনত্ব শহর ব্যবস্থায় বেশি হওয়ায় করোনার ঝুঁকিটাও শহরে বেশি। করোনার উর্দ্ধগতি রোধকল্পে সরকারের গৃহীত বিভিন্œ পদক্ষেপ সময়োপযোগী হলেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন সঠিক হয়নি। করোনা নির্মূল না হওয়ার পরও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারের বিধি নিষেধ কঠোর ছিল না বলে অনেকেই মনে করেন।
এক্ষেত্রে সরকার আরো কঠিন পদক্ষেপে থাকলে হয়তো করোনা থেকে মুক্তির পথটা আরো সহজ হতো। সব কিছু মিলিয়ে সরকারের বর্তমান লকডাউন ব্যবস্থাটা বাস্তবায়ন করা অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেই করোনার প্রকোপ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং প্রচুর জানমালের ক্ষতি হবে। যা দেশের জন্য অনেকটাই অশনি সংকেত।
এ থেকে উত্তোরণের জন্য সরকারের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেমন জরুরি তেমনি মানুষকে সরকারের বিভিন্ন নির্দেশনা মেনে চলা জরুরি। কারন সরকারের পক্ষে কোন নীতিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব না যদি জনগণ সহায়তা না করে। মানুষকে মনে রাখতে হবে এইসব বিধি নিষেধ আমাদের জন্য এবং আমাদের বাঁচানোর জন্য।
নিজে জীবিত না থাকলে জীবিকা কিসের। প্রত্যেকেই তার নিজ পরিবারের জন্য একটি স্বপ্ন। স্বপ্নই যদি বেঁচে না থাকে তাহলে পরিবারের গতি থাকবে না। সরকারের যেসব নির্দেশনা রয়েছে তার মধ্যে মাস্ক ব্যবহার করা। মাস্ক ব্যবহারেও রয়েছে জনসাধারণের অসচেতনতা। এসব না মানার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে সরকারের নির্দেশা মেনে করোনা মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হবে জনগণকে।