স্মরি শ্রদ্ধার সাথে : ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ – মো. আবুল কালাম আজাদ

প্রকাশিত: ৫:০১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৭, ২০২১

আমি তখন বেকার। ২০০৯ সালের দিকে আমি তখন সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকুরীর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। একটি সরকারি দপ্তরে কর্মকর্তা পদে নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষায় আমার বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলায় জেনে একজন পরীক্ষক আমাকে প্রশ্ন করেন, তুমি কি আখলাকুল হোসাইন আহমেদ এর নাম শুনেছ! আমি ইতিবাচক জবাব দিয়ে জানালাম তিনি গণপরিষদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। পরে তিনি আমাকে আখলাকুল হোসাইন আহমেদ এঁর ব্যাপারে আরও জেনে নিতে পরামর্শ দিলেন। পরীক্ষার পর পরই বাইরে এসে আমি সাথে সাথে শ্রদ্ধেয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান মহোদয়কে মুঠোফোনে কল করে বিষয়টি জানালে তিনি আমাকে বললেন রাতে কল দিও, তোমাকে আরও কিছু তথ্য দিব।

মো. আবুল কালাম আজাদ

আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি, যিনি শুধু একজন ব্যক্তিই নন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব, একটি প্রতিষ্ঠান। ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ সেই ব্যক্তিত্ব যিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের নির্মম খবরটি রেডিওতে প্রচারের পর নেত্রকোনা জেলার প্রত্যন্ত জনপদ খ্যাত মোহনগঞ্জ উপজেলায় তাঁর নেতৃত্বে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল ও গায়েবানা জানাজার ব্যবস্থা করেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের এহেন পরিস্থিতিতে এধরণের কর্মসূচি প্রমাণ করে জাতির জনকের প্রতি তাঁর অকপট আনুগত্য, শ্রদ্ধা, দৃঢ় চেতনা ও রাজনৈতিক বিশ্বাসে অবিচল থাকার প্রতিফলন। পরবর্তীতে এমন দুঃসাহসিক কর্মসূচি পালনের দায়ে ১৯৭৬ সালের শুরুতে তাঁকে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে নিয়ে আটক করা হয়েছিল এবং মোহনগঞ্জ না ছাড়ার শর্তে একইদিন সন্ধ্যায় সেনা ক্যা¤প ছেড়ে বাসায় গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছিল।

 

গণপরিষদ সদস্য ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ ১৯২৬ সালের ১৫ অক্টোবর নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার আদর্শ নগর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক ছিলেন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগন যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধিকার আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে রাজপথে নেমেছিলেন তখন তিনি নিজের ও পরিবারের সুখ স্বাচ্ছন্দের কথা না ভেবে সরকারি চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনে যোগ দেন।

ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে নেত্রকোনা মহকুমাধীন মোহনগঞ্জ-বারহাট্টা নির্বাচনী আসনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাকিস্তান সামরিক জান্তা যখন নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে অস্বীকার করলো তখন দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভারতে পাড়ি জমান এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেন।

বদ্বীপ খ্যাত এই স্বাধীন জনপদের মানুষের রাষ্ট্রবিধান তথা ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন এবং তিনি সংবিধানের একজন স্বাক্ষরকারী। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান‘র আহ্বানে এবং তাঁরই নেতৃত্বে উজ্জীবীত হয়ে ১৯৭১ সালে ৯ মাসব্যাপী চলমান মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার অন্তর্গত মহেষখলা ইয়ুথ ক্যা¤প ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন ছাড়াও সিভিল এডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল ময়মনসিংহের নর্থ ইস্ট জোনের চেয়ারম্যান হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় ১৯৭২ থেকে ২০০৩ সাল অবধি নেত্রকোনা জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে ওতপ্রোত সক্রিয় থেকে মানুষের আস্থা ও ভালবাসা অর্জন করেছিলেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের সন্তান কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মায় না, সে মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা বা বীজ নিয়ে জন্মায় মাত্র, কিন্তু শিক্ষাই মানুষের সন্তানকে মানুষ করে গড়ে তোলে। সন্তানকে মানুষ করে গড়ে তুলতে না পারলে অন্য সবকিছুই প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ডায়রিতে আরও লিখেছেন, ‘শিক্ষকদের বলা হয় শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় পিতা। জন্মদাতা পিতা সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখায়। আর শিক্ষক দেখায় জ্ঞানের আলো। যে পিতা তার সন্তানকে রেখে আহার করে, সে পিতা নামের অযোগ্য, সেই রকম যে শিক্ষক তার ছাত্রদের জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত রেখে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে সে শিক্ষকও শিক্ষকতা পেশার উপযুক্ত নয়।’ ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ‘র সুযোগ্য পুত্র সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি শ্রদ্ধেয় ওবায়দুল হাসান মহোদয় ও পারিবারিক সূত্রে পাওয়া শিক্ষা ও শিক্ষিত সমাজ বিনির্মাণে প্রতিফলন উঠে এসেছে তাঁর চিন্তায়-মননে।

 

এই মহান ব্যক্তিত্ব গণপরিষদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ‘র আজ ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী। জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? কবির এ চরণ দুটি প্রত্যেক মানুষের জীবনের এক কঠিন সত্য। ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ ২০১২ সালের ২৮ আগস্ট ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, সেদিন যখন তিনি অস্বস্থি বোধ করছিলেন তখন অ্যাম্বুলেন্স করে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সকাল ১০ টা ৩০ মিনিটের সময় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদ‘র সুযোগ্য পুত্র সাজ্জাদুল হাসান বাংলাদেশের মানবিক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা‘র আস্থাভাজন হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন পরবর্তী বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ওবায়দুল হাসান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে সগৌরবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এই মহান ব্যক্তিত্বের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি বিদেহী আত্নার শান্তি কামনা করছি।

মো. আবুল কালাম আজাদ
বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতার্কিক
চেয়ারম্যান, ময়মনসিংহ ডিবেটিং সোসাইটি, ময়মনসিংহ।

akazaddebate@gmail.com