কলিহাসান,দুর্গাপুর(নেত্রকোনা)প্রতিনিধি :
নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় এক সময় শহর ও গ্রাম সবখানে বাঁশের তৈরী মোড়া ও মিটসেফ’র ব্যবহার ছিলো সচরাচর। বাড়িতে মেহমান ও আত্বীয়-স্বজন আসলে মোড়ায় বসতে দেয়ার দৃশ্য এখন আর ছোখে পড়ে না। এখনকার মানুষ হস্তশিল্পকে ভুলতে বসেছে। দুর্গাপুর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশশিল্প ও বাঁশবাগান। আবহমান কাল থেকে দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজে বাঁশের ব্যবহার চলে আসছে। বাসগৃহে ব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রীর দাম তুলনামূলক কম থাকায় বাঁশের তৈরি হস্তশিল্পের পরিবর্তে বর্তমানে মেশিনে তৈরি প্লাস্টিকসামগ্রীর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে গৃহস্থালিদের। ফলে দুর্গাপুর উপজেলার গ্রামবাংলার পরিচিত বাঁশশিল্প অনেকটা বিলুপ্তির পথে। বাঁশশিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই বাপ-দাদার আমলের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েন।
বর্তমানে প্লাস্টিকের চেয়ার দখল করেছে মোড়ার স্থান। রান্নাঘরেও ঢুকেছে বাঁশের পরিবর্তে লোহার পাত দ্বারা তৈরী মিটসেফ। একসময় গ্রামে বাঁশের তৈরী ঝুড়ি, ধামা, মোড়া, কুলা, মাছ ধরার নানান জাতের ফাঁদ ধান রাখার ডোল, গোলা ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। কালের আবর্তে আধুনিক সভ্যতার উৎকর্ষতায় হারিয়ে যেতে বসেছে এসবের ব্যবহার। শুধু হারায়নি গভীর দরদে সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় যারা এসকল জিনিস পত্র তৈরী করতো সে সকল কারিগর। থবে অনেকে পূর্ব পুরুষদের সেখালের এসকল কাজ এখনও করে যাচ্ছেন,তবে বাণিজ্যিকভাবে নয় নিজেদের ব্যবহারের জন্য ও মাঝে মধ্যে খুচরা দু’একটি বিক্রিও করছেন।
ঐতিহ্যবাহী বাঁশশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঘরবাড়ি নির্মাণ কাজে বাঁশঝাড় উজাড় হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি প্লাস্টিকসামগ্রীর সহজলভ্যতা ও বাঁশে তৈরি উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় উপজেলায় বাঁশশিল্প এখন বিলুপ্ত হতে চলেছে। কয়েক বছর ধরে বাঁশশিল্পে চলছে চরম মন্দা। ফলে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল লোকজন বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকেই আবার এ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। এখনোও এ পেশায় জড়িত আছে বেশক’টি পরিবার। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তার ধারে বাড়ির আঙিনায় বসে বাঁশের চটা দিয়ে চাটাই, কুলা, ডালা, চাঙ্গাড়ি, চালনি, মাছ রাখার খালই, ঝুড়ি, মোড়া, ঝাঁকা, মুরগির খাঁচাসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরি করছেন। গৃহিনীরা রান্না ও ঘরের কাজ শেষে বাঁশের তৈরি সামগ্রী তৈরি করছেন। বর্তমানে ক্রেতার অভাব আর এ শিল্পের মূল উপকরণ বাঁশের মূল্য বৃদ্ধিতে কুটির শিল্পীরা তাদের পেশা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন।
পৌর সদরের বাঁশ ব্যবসায়ী শিল্পী মো. হারাধন সাহা জানান, অন্যান্য জিনিসের চেয়ে বর্তমানে চাটাই/টুকরি, মুরগির খাঁচার চাহিদা বেশি থাকায় তারা এখনো এ ব্যবসা ধরে রেখেছেন। বাঁশের তৈরি এসব জিনিসপত্র মানে উন্নত হওয়ায় দেশের বিভিন্ন পাইকাররা এসে নিয়ে যান।
দুর্গাপুরের বাঁশ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক ও বাঁশশিল্পী মো. জুয়েল বলেন, বাঁশের মূল্য বেড়ে যাওয়ার পরও নিরুপায় হয়ে পরিবারের সবাই মিলে পৈতৃক পেশা ধরে রেখেছি। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাঁশ শিল্পীরা এ পেশা ধরে রাখতে চান। বিদেশেও বাঁশের তৈরি সৌখিন জিনিসের অনেক কদর আছে। সরকার এসব শিল্পীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং কারিগরি উপকরণ সরবরাহ করলে বাঁশ শিল্পীরাও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবেন।
বাঁশ শিল্পী মো কামাল ও শহিদুল মিয়া জানান, বর্ষাকালে আগের মতো পানি না হওয়ায় এবং কৃষিতে কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যাবহারে খাল বিলে মাছ না থাকায় মাছ ধরার নানান ফাঁদ তৈরী করা বাদ দিয়েছেন অনেক আগে। এদিকে কৃষক আর গোলা ভরে ধানও রাখতে পারেনা কারণ ধান ওঠার সাথে সাথে বিক্রি করে উৎপাদন ব্যায় পরিশোধ করতে হয়। কাজেই ব্যবহার কমেছে গোলা আর ডোলের। তাই এখন ঝুড়ি, টেপারী ও চাটাই এর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে বাঁশ শিল্প। অথচ একসময় ছিল কি শহর কি গ্র্রাম প্রতিটি বাড়িতে বাঁশের তৈরী জিনিসপত্র ছাড়া যেন কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু কালের আর্বতে আমাদের বাঁশ শিল্প এখন মৃত প্রায়। কিন্তু এখনও এ শিল্পকে আঁকড়ে আছে পোড় খাওয়া স্বল্প সংখ্যক শিল্পী যারা পূর্ব পুরুষের শেখানো কাজের ওপর মেধা ও শ্রম দিয়ে দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন মৃতপ্রায় এ শিল্পটিকে।
কয়েকজন কুটির শিল্পী জানান, দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে তারা এ পেশায় আছেন। লাভ কম হলেও মাঠে কৃষি জমি না থাকায় এখনও এ পেশায় জড়িত থাকতে হচ্ছে তাকে। তারা স্বামী স্ত্রী ২ জনে মিলে দিনে ৪/৫টি টেপারী তৈরী করে। প্রত্যেকটি টেপারী ৩৫ টাকা দরে বিক্রি করে। এতে টেপারী প্রতি ১৫ টাকা করে লাভ থাকে। এদিয়েই কোন রকমে চলছে তাদের সংসার। তবে এবার শহুরে পরিবারে, অফিস, রেস্তারায় রঙ তুলির ব্যবহার করা বাঁশ ও বেতের তৈরী জিনিস সোপিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিদেশের বাজারেও এর রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। এতে ভালো মুনাফাও পাওয়া যায় বলে জানতে পেরেছেন এ কালের বাঁশ শিল্পীরা। কিন্তু রঙ তুলি দিয়ে বাহারী জিনিসপত্র কিভাবে তৈরী করতে হয় সে কৌশল জানা নেই তাদের। দুর্গাপুরের বাঁশ শিল্পীরাও চায় তাদের তৈরীকৃত জিনিস পত্রে শৈল্পিক রুপ দিতে।
এজন্য দুর্গাপুরের কুটির শিল্পীরা সরকারী বা বেসরকারীভাবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং সুদমুক্ত ঋণ দিতে সরকারের কাছে জোর দাবী জানান। অন্যদিকে শিল্পপ্রেমীরা চান কোন ভাবেই যাতে দেশে দুর্গাপুরের ঐতিহ্যবাহী এই বাঁশ শিল্প কালের আর্বতনে হারিয়ে না যায়।
এনিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার(ইউএনও) মোহাম্মদ রাজীব উল আহসান বলেন,কুটির শিল্প আমাদের ইতিহাস ,ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বটে। এটি কিভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়। সে বিষয়ে ডিসি স্যার এর পরামর্শক্রমে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।