দেশের খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বিজলী-কৃষাণ কর্মসূচি গ্রহণের দাবী

প্রকাশিত: ৮:২৬ অপরাহ্ণ, জুলাই ১২, ২০২৩

স্টাফ রিপোর্টার : খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বিজলী-কৃষাণ কর্মসুচি গ্রহণের দাবীতে সচেতনতামুলক আলোচনা সভায় দেশের চলমান বিদ্যুৎ সমস্যার পরিবেশসম্মত সমাধান হিসেবে দেশব্যাপি এগ্রোভোল্টাইক প্রযুক্তিনির্ভর “বিজলী-কৃষাণ কর্মসূচি” গ্রহণের দাবী জানানো হয়। পাশাপাশি, এলএনজিসহ জীবাষ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানের সকল পরিকল্পনা বতিল করে “মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা” অনুসারে ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের দাবীও জানান বক্তারা।
মাটি বাংলাদেশ, ক্লাইমেট চেঞ্জ নেটওয়ার্ক ইন গ্রেটার ময়মনসিংহ (সিসিএনজিএম), কোস্টাল লাইভলিহুড এন্ড এনভায়রনমেন্টাল একশন নেটওয়ার্ক (ক্লিন) এবং বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটারনাল ডেব্ট(বিডব্লিওজিইডি)-এর যৌথ উদ্যোগে ১২জুলাই ২০২৩ ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সচেতনতামূলক আলোচনা সভা থেকে এসব দাবী জানানোহয়।
সভায় বক্তারা বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাষ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অনেকাংশে দায়ি। এজন্য বিশ্বব্যাপি সকল দেশই নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছে। প্যারিস চুক্তি অনুসারে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে কয়লা ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির মতো যতো দ্রুত সম্ভব এলএনজিও বন্ধ করতে হবে। এছাড়া জরুরি ভিত্তিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যায্য ও সবুজ জ্বালানিতে রূপান্তর করতে হবে। ২০২১ সালের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশের আবহাওয়া সৌরবিদ্যুৎতের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। সৌর-বিদ্যুৎকেন্দ্রে একবার বিনিয়োগ করলে পরবর্তী ২৫ বছর রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া আর কোনো খরচ নেই। তাছাড়া,কয়লা, ফার্নেস অয়েল, ডিজেল এবং এলএনজি-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। চলতি বছরের বাজেটে যে ২৩ হাজার কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা দিয়ে প্রায় ৪০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব। এছাড়া সৌর-বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় কোনো জ্বালানি খরচও নেই। ফলে, কয়লা, ফার্নেস অয়েল, ডিজেল এবং এলএনজি আমদানি-ব্যয় সাশ্রয় হবে যা দেশের অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করবে।
অথচ বিদেশি ঋণদাতাদের চাপে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপর গুরুত্বারোপ না করে তাদের পরামর্শকদের তৈরি বিদ্যুতখাত বিষয়ক মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি) অনুসারে আমদানিকৃত জীবাশ্ম জ্বালানি বিশেষ করে তরলীকৃত জীবাশ্ম গ্যাস (এলএনজি)-এর উপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতিযোগিতামূলক দরে এলএনজি কিনতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যয় হয়ে যায় যা দেশের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাছাড়া, এলএনজি’র আন্তর্জাতিক বাজার এত অস্থির যে তার ভবিষ্যৎ কখনওই নির্ধারণ করা যায় না। ২০১৮ সালের জুনে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি’র দর ছিলো ৩.০২ ডলার যা ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ১,২৫৮% বেড়ে ৩৮ ডলারে পৌঁছে যায়। ২০২২ সালের আগস্টেএর দাম আবারো ২০৫% বেড়ে ৭৮ ডলার হয়ে যায়। বাংলাদেশ তেল গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) থেকে বিদ্যুৎ খাতে প্রতি ঘনমিটার ১৪ টাকা দরে স্থানীয় জীবাশ্ম গ্যাস সরবরাহ করা হয়। অন্যদিকে, প্রতি এমএমবিটিইউ ১৩ ডলার দরে প্রতি ঘনমিটার এলএনজি’র দাম পড়ে ৫১.৩৭ টাকা। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)’র হিসাব অনুসারে বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্যাস থেকে প্রতি ইউনিট (শডয) বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩.৪৭ টাকা খরচ হয়েছে। এলএনজি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে প্রতি ইউনিটে ১২.৭৩ টাকা খরচ হবে। এত দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কেনা সাধারণ মানুষের পক্ষে খুবই কষ্টকর হবে।
এলএনজিসহ অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির দাম যখন বাড়ছে তখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিশেষ করে সৌরবিদ্যুতের দাম প্রতি বছর কমে যাচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের দাম ছিলো ১৬.৪০ টাকা, মাত্র চার বছর পর ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ৩৬% কমে ১০.৫৬ টাকায় নেমে এসেছে। বিপিডিবি’র সম্পাদিত সর্বশেষ চুক্তি অনুসারে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের দাম পড়বে ৮.০৮ টাকা। অর্থাৎ, সৌরবিদ্যুতের দাম প্রতি বছর গড়ে ১২ শতাংশ কমে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, সর্বশেষ চুক্তি অনুযায়ী ভারতে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের দাম পড়ছে মাত্র ২ টাকা ৩৫ পয়সা।কাজেই বক্তারা ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এলএনজি নির্ভর বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মানের পরিকল্পনা বাতিলের জোড় দাবী জানান।

বক্তারা আরও বলেন, বর্তমান সরকার “মুজিব ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্লান (এমসিপিপি)” প্রণয়ন করেএক যুগান্তকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এমসিপিপিতে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০%, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০% এবং ২০৫০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১০০% নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করণে যুগান্তকারি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে যা অত্যন্ত সাধুবাদযোগ্য এবং অর্জনযোগ্যও বটে।এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের জমির স্বল্পতাকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয় যার সমাধান হিসবে সৌর বিদ্যুতের “এগ্রোভোল্টাইকপ্রযুক্তি” বিশ্বব্যাপী দ্রুত সমাদৃত হচ্ছে।২০০৪ সালে জাপানে বাণিজ্যিকভাবে বিজলি-কৃষি কর্মসূচি শুরু হয়। ২০১০ সালে জার্মানিতে প্রথম ‘বিজলি-কৃষাণ” সমবায় সমিতি গড়ে ওঠে। এরপর অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, চিলি, চীন, ক্রোয়েশিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইসরায়েল, ইতালি, জাপান, মালয়শিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর ৩০টি দেশে ‘বিজলি-কৃষি’ প্রবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো ‘বিজলি-কৃষি’ কর্মসূচি নেয়া হয়নি। তবে, সিরাজগঞ্জে ৬.৫ মেগাওয়াট সৌর-বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্যানেলগুলো খুঁটির উপরে বসিয়ে দুই সারির মধ্যে ফাঁকা রাখা হয়েছে। এর ফলেই নানান রকম শাকসবজি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। কাজেই দেশে “বিজলী-কৃষাণ কর্মসূচি” গ্রহণ করে এই প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার সম্ভব হলে “মুজিব ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্লান”-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজতর হবে। কাজেই সভায় বক্তারা পরিবেশসম্মত খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জনে “বিজলী-কৃষাণ কর্মসূচি” গ্রহণের জোড় দাবী জানান।
সিসিএনজিএম নেটওয়ার্কের সম্পাদক খন্দকার ফারুক আহমেদ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক অমিত রায়, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)র যুগ্ম আহবায়ক এডভোকেট শিব্বির আহমেদ লিটন, প্রথম আলো’র জেলা প্রতিনিধি কামরান পারভেজ, মোস্তাফিজুর সমকাল প্রতিনিধি রহমান, দি ডেইলি স্টার জেলা প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম, দৈনিক স্বজন বার্তা সম্পাদক মোঃ কামাল হোসেন, দৈনিক স্বদেশ সংবাদ স্টাফ রিপোর্টার রঞ্জন মজুমদার শিবু, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) জেলা প্রতিনিধি হুমায়ুন কবির লোটাস প্রমুখ। সভায় আলোচনাপত্র উপস্থাপন এবং মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন মাটি বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিচালক কৃষিবিদ মো: শহীদুল ইসলাম।
সিসিএনজিএম নেটওয়ার্কের সদস্য সংস্থাসমূহের প্রতিনিধি ছাড়াও মাটি সমবায়ের কৃষাণ-কৃষাণী সদস্যবৃন্দ, কৃষি, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কাজ করেন এমন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন।