মতিউর রহমান সেলিম, ত্রিশাল :
লিয়াজোঁ অফিসের নামে উপাচার্যের ছেলে-মেয়েদেরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনা-নেয়াসহ তার পরিবারকে সার্ভিস দিতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের টয়োটা টানা প্রায় বছর দুই ধরে ঢাকায়। উপাচার্য প্রফেসর ড. সৌমিত্র শেখরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বাসা থেকে চলাচল করে ওই টয়োটা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসেব অনুযায়ি ওই গাড়ির জ্বালানী খরচ ও চালকের বেতন বাবদ কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এটা নিয়ম বহিভর্’ত বলে জানিয়েছেন অনেকেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন। তিনি কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলেও তার স্ত্রী-সন্তান থাকছেন সাবেক কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ফুলার রোডের ২০ নম্বর বাসায়। উপাচার্য ব্যবহারের জন্য পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জিপ। এখানে যোগদানের পরপরই উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকাস্থ লিয়াজোঁ অফিসের নাম করে, তার স্ত্রী-সন্তানদের ব্যবহারের জন্য কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের টয়োটা গাড়িটি স্থায়ীভাবে পাঠিয়ে দেন ঢাবিতে।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই টয়োটায় চেপে শপিং মলসহ বিভিন্নস্থানে ঘুরে বেড়ান উপাচার্যের স্ত্রী। উপাচার্যের ছেলেকে নিয়ে বুয়েটে আর মেয়েকে নিয়ে উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও চলাচল করে টয়োটাটি। এভাবেই টানা প্রায় দুই বছর ধরে উপাচার্যের পরিবারের সদস্যদেরকে সার্ভিস দিয়ে আসছে ওই টয়োটাসহ যেকোন একজন চালক। কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহনের জন্য গত বছর নিয়োগপ্রাপ্ত জাকির নামে এক চালক প্রায় এক বছর ধরে সর্বদা নিয়োজিত রয়েছেন সেই টয়োটাতে। কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেস্ব তহবিল থেকে ওই গাড়ির জ্বালানী খরচ ও চালকের বেতনের অর্থও পরিশোধ করা হচ্ছে নিয়মিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, প্রথম দিকে ওই টয়োটা চালাতে এবিশ্ববিদ্যালয়ের চালক এরশাদুল হক শাহিনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন উপাচার্য। ৮/৯ মাস ঢাকায় অবস্থানের পর সেখানে থাকতে আপত্তি জানায় ওই চালক। পরিবারের সদস্যদের সার্ভিস না দেয়ার ক্ষোভে ওই চালককে শোকজ করেন উপাচার্য প্রফেসর ড. সৌমিত্র শেখর। দীর্ঘসময় পর সমাধান হয় বিষয়টি। তবে ভয়ে এবিষয়ে বিস্তারিত জানাতে নারাজ ভোক্তভোগি চালক এরশাদ।
কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি নিয়মিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলাচল ও একজন চালক সেখানে অবস্থানের আপত্তিতে শোকজের বিষয়টি উপাচার্যের সেচ্ছাচারিতা ও নিয়ম বহিভর্’ত বলে জানিয়েছেন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি সরেজমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ফুলার রোডে ঘন্টা দুই অপেক্ষার পর দেখা মেলে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই টয়োটো গাড়িটির। গাড়ি থামে ওই রোডের ২০ নম্বর বাসার সামনে, এরপর গাড়ি থেকে নেমে আসেন স্বুল ড্রেসপড়া উপাচার্যের এক মেয়ে ও তার স্ত্রী।
সাংবাদিক পরিচয় না দিয়ে একজন চালক পরিচয়ে ওই টয়োটা চালক জাকির হোসেনের সঙ্গে কথা হলে প্রথমবার ‘লিয়াজোঁ অফিসের জন্য গাড়িটি ব্যবহার হচ্ছে’ জানালেও দ্বিতীয়বার তিনি জানান, গত বছরের ডিসেম্বরে নিয়োগ পাওয়ার পর, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ঢাকায় কর্মরত সে। ভিসি স্যারের ছেলেকে নিয়ে বুয়েটে আর মেয়েকে নিয়ে উদয়নে ও ম্যাডামকে নিয়ে শপিংমল সহ টুকটাক এদিক-সেদিক চলাচল করতে হয় বলে জানিয়েছেন। (তার সঙ্গে কথপোকথনের অডিও রেকর্ড আছে)
এদিকে স্বজনের কাছে আসা ২০২২-২৩ অর্থবছরের এক তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত পেট্রোল ও গ্যাস বাবদ ওই টয়োটার জ্বালানী খরচ হয়েছে ৮১ হাজার তিনশত বার টাকা। ওভারটাইম ছাড়াই চালক জাকিরের ৯৭০০/= স্কেলে আনুমানিক ১২/১৩ হাজার টাকা উত্তোলন অনুযায়ি ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেতন পেয়েছে সে। হিসেব অনুযায়ি উপাচার্যের পরিবারের জন্য বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। একই অর্থবছরে উপাচার্যের ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্বালানী বাবদ-ই খরচ পরিশোধ করেছে ৩ লাখ ১৫ হাজার দুইশ ছিয়ানব্বই টাকা। মাসিক ২৫ হাজার টাকা হারে তার ব্যক্তিগত গাড়ির চালকের বেতন দিতে হয়েছে বছরে ৩ লাখ টাকা। সেই অনুপাতে উপাচার্যের দুই গাড়ি বাবদ প্রতিবছর খরচ হচ্ছে সাড়ে ৮ লাখেরও বেশি।
এসব বিষয়ে জানতে সোমবার ভারপ্রাপ্ত পরিবহন প্রশাসক ড. মো. আরিফুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এব্যাপারে মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারবেন না জানিয়ে লাইন কেটে দেন। পরে মঙ্গলবার তার অফিসকক্ষে দেখা করে এ বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লিয়াজোঁ অফিসের জন্য গাড়িটি ঢাকায় আছে, এর বাইরে আমি কিছু বলতে পারবো না।
এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবির বলেন, অফিস অর্ডার করে ওই গাড়িটি ঢাকা অফিসের জন্য ঢাকায় রেখেছি।
লিয়াজোঁ অফিসের নামে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের টয়োটা উপাচার্যের স্ত্রী-সন্তানদের জন্য ঢাকায় ব্যবহার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে ওই গাড়ির জ্বালানী খরচ ও চালকের বেতন পরিশোধ করা আইনের লংঘন বা নিয়ম বহিভর্’ত কিনা এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি।
তবে লিয়াজোঁ অফিসের কেয়ারটেকার রাসেল হোসেন জানান, আমার জানামতে এই অফিসের জন্য নিদ্রিষ্ট টয়োটা বা অন্য কোন গাড়ি নেই।
এ ব্যাপারে উপাচার্য প্রফেসর ড. সৌমিত্র শেখরের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, যেকোন বিষয়েই হউক, আপনি লিখিত বক্তব্য চাইবেন, আমি লিখিত জবাব দেবো।