গৌরীপুরে বড়কর্তার আগমনে ঘন্টায় একরাতে সরিয়ে নেয়া হলো শত অবৈধ দোকানপাট

‘দুর্গন্ধে স্টেশনে থাকা দায়, জংশন যেন ডাস্টবিন’

প্রকাশিত: ৯:০০ অপরাহ্ণ, মার্চ ৩০, ২০২২

গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি :
আজ বৃহস্পতিবার (৩১মার্চ/২০২২) আসবেন বড়কর্তা! এইটুকুই জানেন স্টেশন এলাকার মানুষ! যার কারণে বদলে গেছে চিরচেনা দুর্গন্ধযুক্ত ও রেলঞ্চলে অবহেলিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ঐতিহাসিক গল্পের ‘গৌরীপুর জংশন’। এ স্টেশন পরিদর্শনে আসবেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সহকারী রেল পরিদর্শক। চাহিদার কয়েকগুণ বেশি আয় হওয়ায় ২০১৮সালে এ স্টেশনকে ‘ক’ শ্রেণিতে উন্নিত করা হয়। আয় বাড়লেও বাড়েনি সেবা, পথেপথে দুর্ভোগ আর স্টেশন চলছে ৪০বছরের পরিত্যক্ত ভবনে।

এ কর্মকর্তার আগমন বার্তায় বুধবার স্টেশনে ঘুরে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র; অবাক হওয়ার মতোই দৃশ্য কাগজের টুকরাও নেই স্টেশনের এলাকায়। যাত্রীদের বিশ্রামাগার ও বার্থরুমের দুর্গন্ধ নেই, এখন সুগন্ধ বের হচ্ছিলো, স্টেশন এলাকা যেন ‘বিদেশের বিমানবন্দর’ এর মতো ছিলো সাজানো-গোছালো। রাতারাতি সরিয়ে নেয়া হয় শত অবৈধ দোকানপাট। ক্ষমতাশালীদের সেই অবৈধ স্থাপনার সঙ্গে বড় কর্তার আগমনে ভেঙে ফেলে দেয়া হয়েছে ‘অসহায় ছিন্নমূল গৃহহীন রুপালীদের ঘরও’। তবে এমন বড়কর্তা ২০১৮সনের ১১নভেম্বর এ স্টেশন পরিদর্শন করেন। সেই বড়কর্তা সহকারি রেল পরিদর্শক নাসির উদ্দিন আহমেদ চলে যাওয়ার ২৪ঘন্টার মধ্যেই সরূপে ফিরে আসে এই জংশন!


এ স্টেশনের দুরবস্থা নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় ২৮ অক্টোবর ‘গৌরীপুর জংশন রেলস্টেশন পরিত্যক্ত ভবনেই ৩৭বছর’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে ছিলো ‘দুর্গন্ধে স্টেশনে থাকা দায়, জংশন যেন ডাস্টবিন’। ২৬অক্টোবর প্রকাশিত হয় ‘টিকেট যেন সোনার হরিন” শিরোনামে আরো একটি প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনে উঠে আসে উপজেলার ৪লাখ জনতার জন্যে টিকেট বরাদ্দ মাত্র ২৫টি! যাত্রীদের বসার ঠাঁই নেই, স্টেশনের অধিকাংশ রুম লীজে দিয়ে কর্তৃপক্ষ! শ্যামগঞ্জ রেলওয়ে ৪টি লেবেল ক্রসিংয়ে কোনো গেইটম্যান নেই! ইতোমধ্যে একজন ফেরিওয়ালা ও অটোরিকশার যাত্রী মারা গেছে। আন্দোলন থামাতে তাৎক্ষনিক গেইট দেয়া হলেও পরক্ষনেই সরিয়ে নেয়া হয়। ময়মনসিংহ-সিলেট, মোহনগঞ্জ-সিলেট আন্তঃনগর ট্রেনের দীর্ঘদিনের দাবী বাস্তবায়িত হয়নি। মোহনগঞ্জ-ঢাকা আন্তঃনগর হাওর-টুও আলোরমুখ দেখেনি।


২০১৮সনের ১১নভেম্বর পরিদর্শনে আসেন রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সহকারি রেল পরিদর্শক নাসির উদ্দিন আহমেদ। রেলওয়ের এসব সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন কথা বলেন, প্রতিশ্রুতিও দেন। তবে কোনো প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। এ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মতবিনিময় কালে গৌরীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান ফকিরের নেতৃত্বে গৌরীপুর স্টেশনকে আধুনিকায়ন, গৌরীপুর ও শ্যামগঞ্জে আন্ত:নগর ট্রেনের টিকেট বৃদ্ধিকরণ, ময়মনসিংহ-সিলেট, ঢাকা-জারিয়া রেলপথে আন্তঃনগর ও ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম সঙ্গে আরো আন্ত:নগর ট্রেন চালুকরণ, টিকেটের কালোবাজারীবন্ধের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করেন। এ দাবির প্রেক্ষিতেও কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি গৌরীপুরে!

গৌরীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম মিন্টু বলেন, রেলওয়ে অঞ্চলের মধ্যে অবহেলার শিকার হয়েছে গৌরীপুর রেলওয়ে জংশন। যেখানে ১০টি টিকেট বিক্রি হয় না, সেখানে রেলওয়ে স্টেশন রিমডেলিং করা হয়েছে। অথচ গৌরীপুর জংশন চলছে পুরাতন ব্যবহারে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত ভবনে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, এ স্টেশনে আন্তঃনগর হাওর কাউন্টারের জন্য ১৩টি আর অনলাইনে ১২টি টিকেট বরাদ্দ রয়েছে। অথচ এ উপজেলার জনসংখ্যা ৪লাখের বেশি। আন্ত:নগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে ২৫টি কাউন্টারে আর ২৫টি অনলাইনে, চট্টগ্রামগামী আন্ত:নগর বিজয় এক্সপ্রেসে কাউন্টারে ৪৭টি আর অনলাইনে ৬০টি। গৌরীপুর জংশন হলো ময়মনসিংহ, জারিয়া, মোহনগঞ্জ ও চট্টগ্রামের মোহনা। জারিয়া-মোহনগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামে যেতে-আসতে এখানে ট্রেন পরিবর্তন করতে হয়। চট্টগ্রাম-ভৈরবের ময়মনসিংহগামী ট্রেনের ইঞ্জিন পরিবর্তন করতে হয়। ঢাকাগামী আন্তঃনগর হাওড় এক্সপ্রেস, আন্তঃনগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস, বেসরকারিভাবে পরিচালিত মহুয়া এক্সপ্রেস, বলাকা এক্সপ্রেস, বন্দরনগরী চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর বিজয় এক্সপ্রেস, নাসিরাবাদ এক্সপ্রেসসহ দৈনিক ২৮টি ট্রেনের যাত্রী উঠানামা করে।

এদিকে পরিত্যক্ত ভবনেই ৪০বছর যাবত চলছে রেলওয়ের কার্যক্রম। ভবনের পলেস্তার খসে পড়ছে, অধিকাংশ ভবনে ফাটল, এরপরেও থেকে নেই ঝুঁকিভবনে কার্যক্রম। বছরের পর বছর রঙ মেখে আর দেয়ালে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সারেন। পুরো স্টেশন যেন ডাস্টবিন। রয়েছে টিকেট কালোবাজারীর অভিযোগ। প্রায় ৬বছর পূর্বে জংশনে দু’রেলপথ সংস্কার ও মেরামত করা হয়। যা সচল হওয়ার আগে আবারও অচল হয়ে পড়েছে। রেললাইন সংকটের কারণে আউটার সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকছে হচ্ছে ট্রেন। যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।

অপরদিকে সারাবছরেই ১ম শ্রেণির বিশ্রামাঘারে নেই পানির ব্যবস্থা। ভবনের চারপাশেই ফাটল, অধিকাংশ সময় দরজা তালা লাগানো থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণির বিশ্রামাগারও বসার অনুপযোগী। বাহিরে শত শত যাত্রী অপেক্ষা করলেও বসার ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে গাছতলা বা রেললাইনের ওপরে বসেই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। পুরো স্টেশনে দারি’র (ছাটাই) স্তুপ। স্টেশনের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আর নানা স্থানে ময়লাস্তুপ-আবর্জনার স্তুপে ঢাকা পড়ছে রেললাইনও। দুর্গন্ধে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর। অথচ বড়কর্তার আগমনে সব বদলে গেছে!