বিশ্ব দরবার স্বীকৃত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ : একটি প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ- মো. আবুল কালাম আজাদ

প্রকাশিত: ৯:২৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ৪, ২০২১

“১৯৬৪ সালের ১৮ জুন ময়মনসিংহ টাউন হল ময়দানে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করিলেন, পূর্ব বাংলার ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য সমগ্র প্রদেশে গণআন্দোলন শুরু করিতে হইবে। প্রচন্ড গণআন্দোলন ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান দুরবস্থার নিরসন হইবে না। শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরেও জনসাধারণকে দাবাইয়া রাখার চেষ্টা করিতেছে। আওয়ামীলীগ যেকোনো রাজনৈতিক দলের সহিত সহযোগিতা করিতে প্রস্তুত।” (ইত্তেফাক ১৯ জুন ১৯৬৪)। তিনি আমাদের সার্বজনীন নেতা-ফিদেল ক্যাস্ট্রোর হিমালয়-কারও কারও মতে যীশু খ্যাত; যাঁর এক আঙুলের ইশারায় ১৯৭১ সালের মার্চে একটি শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হতে পেরেছিল, বাংলাদেশ নামে এক চিলতে বদ্বীপ খ্যাত ভূখন্ড আর খাঁটি আর্য বংশ সম্ভূত ত্রিশ লক্ষ দক্ষ কারিগরের লাল-সবুজ রক্তমাখা একটি মানচিত্র নিশ্চিত করতে পেরেছিল তিনিই বঙ্গবন্ধু, তিনিই শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি মার্টিন লুথার কিং ও নেলসন ম্যান্ডেলার পরে পৃথিবীর একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি একটি অসহযোগ আন্দোলনকে সার্থকভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করতে পেরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু’র জীবনের স্বপ্ন আর আকাক্সার এক বাস্তব প্রতিবম্ব ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্সে তাঁর জাদুকরী ও ছন্দময় কথামালার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। শৈশবের আবেগ কখন যে বিবেকে পরিণত হয়ে গেল তা নিজেও জানতেননা। তিনি মনে-প্রাণে যা বিশ্বাস করতেন তাই অনর্গল বলে যেতে লাগলেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ৭ মার্চ একটি স্মরণীয় অধ্যায়, একটি উদ্দীপনা জাগানো আর জাদুকরী ছন্দময় কথামালার নাম। যতরকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-গবেষণা করা হোকনা কেন এর মর্ম কথা দুটি হৃদয় নিংড়ানো বাক্যে প্রকাশ পেয়েছিল।

“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

বন্ধু-শুত্রু সবাই এর তাৎপর্য অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বাঙলার কৃষক, ছাত্র, আপামর জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাক শেয়াল শকুন আর হায়েনাদের বিরুদ্ধে। দৃশ্যপটে বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত অথচ প্রতি মুহূর্তে উজ্জীবীত বাঙালি উপলব্দি করেছে তাঁর অস্তিত্ব। আজ টুঙ্গিপাড়ার সমাধি থেকে বিরিয়ে এসে তিনি পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন সারা বাংলাদেশে। যে বাংলাদেশের তিনি স্থপতি, সেই বাংলাদেশের বস্তুতগত অর্জনের প্রশংসা আজ বিশ্বব্যাপী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত।

“আজ বাঙলার মানুষ মুক্তি চায়-তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা স¤পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাঙলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস বাঙলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও মতায় বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খান ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রাখল। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেয়া হলো এবং এরপর এ অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হলো। —– বাঙলার নিরস্ত্র জনগণের ওপর অস্ত্র ব্যবহার করা হলো। —- আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলুন। —- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি — ।”

বঙ্গবন্ধুর এই ছন্দময় কথামালা আজও ধ্বনিত হচ্ছে এই সবুজ বাঙলার পথে প্রান্তরে। ধ্বনিত হচ্ছে বিশ্বের ন্যায়ত সংগ্রামী মানুষের রক্তে আর শিরা-উপশিরায়। আমার জন্ম স্বাধীনতার ১০ বছর পরে। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি। আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে আমার মায়ের কাছে আমার সবিনয় জিজ্ঞাসা-সেদিন আমি কোথায় ছিলাম ? যেদিন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু রচনা করেছিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাটি। যার কবিতায় বাঙলার আকাশ-বাতাস-মাঠ-ঘাট প্রক¤িপত হয়ে উঠেছিল। শিহরণ জেগেছিল সমগ্র বাঙালির রক্তে। বাঙলার নিরস্ত্র কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক, জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি শেয়াল-শকুন আর হায়েনাদের বিরুদ্ধে। মা, তুমি বল, সেদিন আমি কোথায় ছিলাম? কোথায় ছিলাম সেদিন?
স্বাধীতনতার ৪৫ বছর পর আজ আমরা যে “ডিজিটাল বাংলাদেশ” এর ¯োগান তুলছি সেটি যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের “সোনার বাঙলা”র পরিবর্তিত রুপ তা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। এ নিয়ে আমাদের তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার সুযোগ কম। কেবল “সময়ের প্রয়োজনে” বঙ্গবন্ধুর জীবন-যৌবন-আশা-আকাক্সার নির্যাস, সুনিপুণ সত্ত্বা দিয়ে রচিত অকৃত্রিম স্বপ্ন “সোনার বাঙলা” আজ “ডিজিটাল বাংলাদেশ” এর রুপ পরিগ্রহ করেছে। আমাদের মনে-প্রাণে-অন্তরে এমনকি এই রঙ কাঁচা বাংলাদেশের রঙ পাকা হলেও বিশ্বাস রেখে কাজ করতে হবে এই ভেবে যে, তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি আছেন এবং থাকবেন এই বাঙাল তথা বাঙালির সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে। যখন-তখন-যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে আমাদের কান পেতে শুনতে হবে— বঙ্গবন্ধুর রচিত সব সময়ের জন্য সত্যি কয়েক শব্দ কথন, “আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি — — ।” তাহলেই কেবল ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন অর্থবহ হবে, অন্যথায় নয়। এমনকি ত্রিশ ল শহীদের আত্না শান্তি পাবে এই ভেবে যে আমরা তাঁদের কষ্টার্জিত আর রক্তমাখা স্বাধীন এই ভুখন্ডকে সত্যিকার অর্থেই সোনার বাঙলা রূপ দেয়ার ল্েয তাঁদেরই স্বপ্নের পূরণে কাজ করে যাচ্ছি।
লেখক- মো. আবুল কালাম আজাদ
(বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতার্কিক)
চেয়ারম্যান, ময়মনসিংহ ডিবেটিং সোসাইটি।