সূর্যের উত্তাপ আর দিগন্তছোঁয়া শর্ষে ক্ষেতের সিèগ্ধতার অপর নাম-বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১১:২৩ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৫, ২০২৩

                  -মো. আবুল কালাম আজাদ-

স্বাধীনতা মানুষের মনের একটি খোলা জানালা, যেই দিক দিয়ে মানুষের আত্মা ও মানব মর্যাদার আলো প্রবেশ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার গুরুগম্ভীর আলোচনার ইস্যু ও প্রেক্ষাপট এক দিন কিংবা এক মাসে আলোচনা করেই তাকে শেষ করার ইতিহাস নয়। তাকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ, চেতনায়-উদ্দীপনায়, কর্মে-মন্ত্রে। বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয় এই স্বাধীনতা। দিনের পর দিন রাতের পর রাত বহু সংগ্রামের মাধ্যমেই পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করেই যেন এই সোনার বাঙলা স্বাধীনতা অর্জন করে। আর তাকে রক্ষা কিংবা সুসংহত করার জন্যই জাতীয় জীবনে অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে।
স্বাধীনতাকে রক্ষা করে তা ফলপ্রসূ করতে হলে প্রয়োজন হয় জাতীয় ঐক্য। কিন্তু এ দেশের সকল জনগন আজো কি সেই ঐক্য নিশ্চিত করতে পেরেছে! অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক স্বনির্ভরতা অর্জন কিংবা দেশে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান সহ চিকিৎসার মান উন্নয়নে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ একত্রিত হতে পেরেছে! পৃথিবী নামক গ্রহের বিভিন্ন জাতির স্বাধীনতার অভিজ্ঞতা থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন হলেও তাকে রক্ষা ও ফলপ্রসূ করার কাজটাও অনেক অনেক কঠিন।
মিল্টন বলেছিলেন, স্বাধীনতা মানুষের প্রথম ও মহান একটি অধিকার। সেই অধিকারের জায়গাতেই মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকতে হবে। উন্নয়নের প্রতি সকল মানুষের সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ দূর করতে হবে। তবেই লাখো মানুষের এক সাগর রক্তে কেনা স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্যায়ন নিশ্চিত হবে। আজ সময় এসেছে, এদেশের স্বাধীনতার মর্যাদা হৃদয়ে ধারণ করে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাঙলা বিনির্মাণের প্রশ্নে অধিকতর মনোযোগ নিবিষ্ট করতে হবে।
ইতিহাসের আলোকেই জানা প্রয়োজন যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়, সেই দেশটির নাম বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের এই দিবসটিকে ঘিরেই রচিত হয়েছে স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা দিবসের আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তের মধ্যে প্রথমেই যে কথাটি মনে পড়ে, তা হলো এই দেশের অসঙ্খ্য দেশপ্রেমিক শহিদের আত্মদান। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার সমস্ত মানুষ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসনের গ¬ানি থেকেই মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল। লক্ষ লক্ষ শহিদের রক্তে রাঙানো স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছে এই দিবসটিতে। তাই এ দেশের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস সবচাইতে গৌরবময় ও পবিত্রতম দিন। সুতরাং ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস এবং এই দিবসটিই বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়। জানা যায়, ১৯৭২ সাল থেকেই এ দেশে স্বাধীনতা দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হয়ে আসছে।
এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মূল্যায়ন করে চিত্রশিল্পে, চলচ্চিত্রে, কবিতায়, নিবন্ধ বা গণমাধ্যমসহ নানা মাধ্যমেই যেন গুরুত্বের সাথে ফুটিয়ে তুলেছে। এমন দিন উপলক্ষে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারেও স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজের নানা আয়োজন হয়। তাছাড়া দেশের প্রতিটি উপজেলায় স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজসহ আলোচনা অনুষ্ঠান, মতবিনিময় সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দেশের প্রধান সড়কগুলোতে জাতীয় পতাকা দিয়েও সাজাতে হয়। এইদিনে ঢাকার সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেওয়া স্বাধীন-সার্বভৌম এদেশ আজ গর্বের দেশ। অতএব বলতেই হয় ২৬ মার্চ স্বাধীনতার পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করার এ গৌরবময় দিবসটিই যেন বাংলাদেশের ইতিহাসে মহান স্বাধীনতা দিবস হিসেবেই সমাদৃত।
মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন, তাই সে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। তার এই জন্মগত অধিকার যখন অন্যের দ্বারা লুণ্ঠিত হয় তখনই সে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সব কিছুর বিনিময়েই যেন নিজ স্বাধীনতা এবং স্বদেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়। ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর বাঙালি জাতি দীর্ঘ ২৪ বছর বর্বরোচিত পাকিস্তানি শোষণের নির্মম শিকার হয়েছিল। সেই পরাধীনতার শৃঙ্খলেই যেন আবদ্ধ বাঙালি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মৃত্যুপণ সংগ্রাম শুরু করেছিল। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তিরিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ ও দুই লক্ষ মা-বোনের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আজকের এই স্বাধীনতা।
এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমিকে নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্নবীজ মূলত বপন করা হয়েছিল সেই ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের সময়ে। ১৯৪৭ এর পরবর্তীতে প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন দেখা দিত ক্রমাগত শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্যমূলক আচরণ, ন্যায্য অধিকার প্রদানে অস্বীকৃতিসহ ইত্যাদি বিষয় নিয়েই আন্দোলনের যাত্রা অনেক ত্বরান্বিত হয়েছিল। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এমন সংগ্রাম ১৯৭১ সালে এসেই যেন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। অতএব বাঙালিরা অনিবার্য মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছিল বাঙলা ভূখন্ড।
১৯৭১ সালে মার্চ ছিল উত্তাল, উত্তেজনায় ভরপুর এবং অনেক ভয়ংকর। ২৫ মার্চ রাতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে খুব দ্রুত পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। আর তিনি গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেও যান। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই যেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সংগঠকবৃন্দ অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠন করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র থেকে তীব্রতর উত্তাল আন্দোলন গড়ে তোলে। এই দেশের সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের সর্বাত্মক সহায়তা বা বিশ্বগণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকাসহ ৩০ লক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অবশেষে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ-বেনিয়াদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত-পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও যোজন-যোজন দূরত্ব সত্বেও শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশকে নিয়ে গঠিত হয় নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান। অদ্ভূত দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে যেন পাকিস্তানের শাসকদের অনাচার-অত্যাচার চলতে থাকে আর সর্বেক্ষেত্রে অনেক বৈষম্য-বঞ্চনার স্বীকার হয় বাঙালি জাতি। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর কেবল অর্থনৈতিক শোষণই নয়, বাঙালি সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের ওপরে নিপীড়ন শুর করে। ১১ মার্চ, ১৯৪৮ ঢাকায় পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করেছিল।
রাষ্ট্রভাষা বাঙলার দাবিতে ১৯৪৯ সালে ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ‘বাঙলা ভাষা দিবস’ এর আন্দোলন চালিয়ে যায়। যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ০৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ করাচিতে অনুষ্ঠিত সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভায়। কুমিল্লার কংগ্রেস এম.এল. এ. বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবী করেছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ও বাঙলা দ’ুটোই করা হোক। বাঙলা ভাষাকে সেইদিন মেনে নেওয়া হয় নাই। তারপর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিুক্ষুব্ধ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। বর্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছাত্র জনতার মিছিলে গুলি চালালে শহিদ হয়েছিল রফিক, শফিক, জব্বার, সালাম, বরকত এবং সেদিন আহত হয়েছিলেন আরও অনেকেই। শহিদদের এই পবিত্র রক্তই যেন আজ বাঙালি জাতির হৃদয়ে স্বাধীন লাল-সবুজের পতাকার ছবিও এঁকে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের আবেগী সংগ্রামী মানুষের অজস্র রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা যেন যেকোনো চোরাবালিতে পথ না হারায়, সেই প্রচেষ্টা থাকতে হবে। অন্যথায় এই স্বাধীনতার ভাবমূর্তি অনেকাংশেই ক্ষুণè হবে কিংবা বাঙালি জাতির ভাগ্যেও অশনি সংকেত দেখা দিতেই পারে বা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাঙালি জাতি যেন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। কিন্তু আমরা আশাবাদী। বুড়ি চাঁদ এখনো বেনো জলে ভেসে যায়নি। আজ আমরা আশার আলো জ্বলতে দেখাছি, আমরা দেখছি বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার শর্ত পূরণ করার এক বৃহৎ সক্ষমতা অর্জন করেছে। সব জাতি-গোষ্ঠী মিলেমিশেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই স্বাধীনতা হয়ে উঠবে অর্থবহ।
এই দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে হলে অল্প কথায় শেষ করা যাবেনা। আরও জানা প্রয়োজন রয়েছে যে, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করেছিল। আর মুসলিম লীগের অসহায় ভরাডুবিতে নড়বড়ে হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ভিত। ১৯৫৬ সালেও পুনরায় সরকারি ভাষায় নানা বিতর্ক, আইয়ুব খান এর অপশাসন, পাঞ্জাবি কিংবা পশতুনদের ঋণ বাঙালিদের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কারণেই যেন বাঙালিদের মনের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তেই থাকে।
১৯৬৬ সালে বাঙালির স্বাধিকারের দাবিতে ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। গণ বিক্ষোভ প্রতিহত করতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সামরিক শাসনের মাধ্যমে যেন স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপরে বিভিন্ন কায়দায় চালাতে থাকে অত্যাচার, নিপীড়ন। ১৯৬৮ সালে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কালজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মিথ্যা, সাজানো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি অপশক্তি ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতেও বাধ্য হন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। দফায় দফায় বৈঠক করার পরে ক্ষমতালিপ্সু শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপন করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা’র ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল সমাবেশের ডাক দেন। সমাবেশের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু পুরো জাতিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে উদ্দীপ্ত করেন, আন্দোলিত করেন। এই উদাত্ত আহ্বানের জন্যই যে অপেক্ষা করেছিল বাঙালি। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাঙলায় ছড়িয়ে পড়ে এই ডাক। সর্বত্রই শুরু হয় তুমুল আন্দোলন।

২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট এর পরিকল্পনায় নির্দিষ্ট একজন রাজনীতিবিদকে হত্যা করবার সিদ্ধান্ত ছিল সেই সামরিক কর্তৃপক্ষের। তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যই ছিল যেন আগরতলা ষড়যন্ত্রের প্রধান পরিকল্পনাকারী ও লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটির একজন আহ্বায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোয়াজ্জেম হোসেনকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময়েই হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল অনেকে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট টার্গেট মোয়াজ্জেমকে ২৫ মার্চ সূর্য ওঠার আগে তাঁকে যেন ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় সেই ঘাতকরা পিস্তল দিয়ে পরপর ৫ টি গুলি করে এবং তারা মৃতদেহটি সঙ্গে করেও নিয়ে যায়। তাঁর লাশ আর পাওয়া যায়নি।
সেই ২৫ মার্চের অন্ধকার রাতে বর্বর পাকিস্তানি পশুশক্তিই নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্যটিই ছিল যেন আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন এবং কল্যাণমুখী, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল স্বতন্ত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার কিংবা ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করবার লক্ষ্যেই এই স্বাধীনতা। শোষণ, বৈষম্য এবং অন্যায় এর অবসান ঘটিয়ে যেন ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য অপরসীম। এ দিনটি বাঙালির জীবনে বয়ে আনে আনন্দ-বেদনার অ¤¬মধুর অনুভূতি। একদিকে হারানোর কষ্ট অন্যদিকে প্রাপ্তির আনন্দ। শেষ পর্যন্ত সর্বস্ব হারিয়ে যেন স্বাধীনতা প্রাপ্তির অপার আনন্দটা বড় হয়ে ওঠে বাঙালির কাছে। আশার কথা হলো, আমাদের বর্তমান প্রজন্ম স্বাধীনতার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। এই প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেই এই দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দীক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে। এ জন্যেই এদের হাতে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসটিকে তুলে দেওয়া জরুরি।
মুক্তিযোদ্ধা যারা রয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকে সঠিক ইতিহাস সংগ্রহ করে ইতিহাস বিকৃতি রোধে ব্যাপক কাজ করা প্রয়োজন। দল ও ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে কল্যাণমুখী রাজনীতির চর্চারও প্রয়োজন রয়েছে। গণতন্ত্রকে সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে আজও যেন রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব অনেক পীড়াদায়ক। এ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তিতে যেন আজও দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি নিয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেইদিন বাঙলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের দুঃখের অবসান হবে। আমাদের সামনে সম্ভাবনা অসীম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবেই সব সমস্যা মোকাবেলায় সচেষ্ট হই তাহলেই স্বাধীন দেশের উন্নয়ন বা অগ্রগতি আশা করা যায়।
জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, আমি আমার নিজের বাংলাদেশকে নিয়ে অসম্ভবরকম আশাবাদী। আমাকে যদি একশোবার জন্মাবার সুযোগ দেওয়া হয় আমি একশোবার এই দেশেই জন্মাতে চাইব। এই দেশের বৃষ্টিতে ভিজতে চাইব। এই দেশের বাঁশবাগানে জোসনা দেখতে চাইব।
আমরা সবাই মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে অগ্রসর হবো, আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবো এবং আমরা কাজ করবো সৃজনশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবার জন্য . . . এই হোক স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার।
দেশ-মাটি আর মানুষের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ। একদিকে বৈরী সংস্কৃতি, অন্যদিকে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রেতাত§ার পুনরুত্থানের চেষ্টা চলছে নতুন পোশাকে। ওরা যেন এগিয়ে আসছে আগুনমুখে সব গ্রাস করে নিতে। তবে বিশ্বাস আছে, যুগে যুগে এদের প্রতিহতকরণের অন্য নামই- বাংলাদেশ; যা হারিয়েছি তা খুঁজে ফেরা, তার নতুন ও সমৃদ্ধ রূপ দেবার নাম- বাংলাদেশ। সূর্যের উত্তাপ আর দিগন্তছোঁয়া শর্ষে ক্ষেতের সিèগ্ধতার অপর নাম- বাংলাদেশ। ওই আকাশের নীল অবশেষে আমরা ছোঁব, শুধু এই কামনা। আমরা যদি জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাঙলাকে সত্যিকার অর্থেই সোনার বাঙলা হিসেবে যদি প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলেই কেবল ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মা শান্তি পাবে। —- জয় বাঙলা।

মো. আবুল কালাম আজাদ
প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলাম লেখক,
বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতার্কিক,
চেয়ারম্যান, ময়মনসিংহ ডিবেটিং সোসাইটি, ময়মনসিংহ।