বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু-সোনার বাঙলা থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ – মো. আবুল কালাম আজাদ

প্রকাশিত: ৯:০৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৫, ২০২১

একটি জাতির আবির্ভাব-সার্বভৌমত্ব, তার আদর্শ অথবা অনুভব, বদ্বীপ খ্যাত এক চিলতে ভূখন্ড শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে অতঃপর হয়ে উঠেছে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন, মানুষ তার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা দিয়ে অংকন করেছে একটি মানচিত্র। এখনও অনেক জায়গায় রঙ কাঁচা, শুকোয়নি পুরোপুরি। সম্পুর্ণ নতুন একটি ছবির মতো করে সাজানো। খাঁটি আর্য বংশসম্ভূত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ দক্ষ কারিগর দীর্ঘ ন’টি মাস দিনরাত পরিশ্রম করে সুনিপুন মন-মগজ নিবিষ্ট করে তবেই নিশ্চিত করেছেন একেবারে নিজেদের একটি স্বত্বা, একটি অনুভব। এরই নাম বাংলাদেশ।

এখনো অনেক জায়গায় রং কাঁচা হলেও — কী আশ্চর্য গাঢ় দেখেছেন ? ভ্যান গগ্– যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে সোনালি তুলে এনে ব্যবহার করতেন শপথ করে বলতে পারি, এমন গাঢ়তা দেখেননি ! অবশ্য উল্লেখযোগ্য তেমন কোন মনোহারী স্পট আমাদের নেই, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসেনা— আপনার স্ফীত সঞ্চয় থেকে উপচে-পড়া ডলার কিংবা স্টারলিং এর বিনিময়ে যা পাবেন, ডালাস অথবা মেস্ফিস অথবা ক্যালিফোর্নিয়া তাঁর তুলনায় শিশুতোষ। রঙের এমন ব্যবহার, বিষয়ের এমন তীব্রতা, ভাব এবং আবেগের এমন গভীরতা আপনি কোন শিল্পীর কাজে পাবেননা। এই বিশাল ছবির জন্য ব্যবহৃত সব উপকরণ অকৃত্রিম। যার কাহিনী, সংলাপ, চিত্রনাট্য এবং নির্দেশনায় একটি নাম — একটি স্বত্বা — একটি মহীরুহ — বঙ্গবন্ধু — বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। ১৯৩৯ সাল। শেখ মুজিবুর রহমান’র রাজনীতিতে প্রবেশ। তিনি মুসলিম লীগের একইসাথে মুসলিম ছাত্রলীগের এক সাধারণ কর্মী। তিনি অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার এবং পাকিস্তান দাবীর ঘোর সমর্থক হলেও সাম্প্রদায়িকতা থেকে তিনি আত্মরা করতে শিখেছিলেন। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের উপদলভুক্ত হওয়ায় তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং একটি ন্যায়পর সমাজ গঠনের চিন্তা নিজের মধ্যে লালন করতে পেরেছিলেন। লালন করতে পেরেছিলেন দেশ-দেশের মানুষ-সমাজ এবং সমাজ-সভ্যতা ও রাষ্ট্রের নব উত্থান কীভাবে নিশ্চিত করা যায় — সেই স্বপ্ন।

দেশভাগের পরে যখন তাঁর পড়াশুনার ক্ষেত্রে কলকাতা ছেড়ে তিনি ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন সোহরাওয়ার্দী তাঁকে একটি উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি শেখ মুজিব’কে বলেছিলেন, ‘দেখো-ওখানে যেন সাম্প্রদায়িক ঘটনা না ঘটে। তাহলে ভারতের মুসলমানরা বিপদগ্রস্ত হবে।’ সে কথা রাখতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি শেখ মুজিব। তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীর সাথে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতাদের দুর্ব্যবহার সত্ত্বেও মুসলিম লীগ বিরোধী কোন কাজ করতে তাঁর মন সায় দেয়নি। ফলে গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গোড়ায় উৎসাহী হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধাচরণই করেছিলেন তিনি।

মুসলিম লীগের কুশাসন এবং রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তাদের কৃত অন্যায় এই শেখ মুজিব’কেই তাদের বিরোধী করে তুলল। সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভুমিকায় যার সূচনা, কারাবন্দী অবস্থায় আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়ায় তার এক ধরণের পরিণতি। যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন মুসলিম লীগের একটি প্রধান দাবি ছিল, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে মুসলিম লীগ তাঁর কথা ভুলেই গেল। শেখ মুজিব এই দাবীটাকেই নিজের রাজনীতিতে প্রাধান্য দিলেন। দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল রাজনীতিতে ধর্মের ভুমিকা নিয়ে। জিন্নাহ যা-ই বলে থাকুন না কেন তাঁর উত্তরাধিকারীরা ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে না দেখে রাষ্ট্রীয় জীবনের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে চাইলেন। শেখ মুজিব চাইলেন ধর্ম ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পৃথক রাখতে।

 

১৯৫৫ সালে ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাতিল করতে যেমন সক্রিয় ছিলেন, পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র রচনার সময় গণপরিষদে তিনি স্পষ্ট করে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণার বিরোধিতা করেন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান রাখার উপরে জোর দেন এবং পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের নাম পূর্ব বাঙলা রাখার দাবী জানান। ইতোমধ্যে শেখ মুজিব একজন নেতা বলে পরিচিতি পান।

 

 

১৯৫৩ সালেই তিনি আওয়ামী মুসলিমলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হয়ে গেলেন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভাসানী ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হলে তিনি হলেন সর্বেসর্বা।

শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে যখন প্রকাশ্যে ছয়-দফা কর্মসূচী উপস্থাপন করেন সেই থেকে এই ছয় দফা আদায়ই হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। অতঃপর তাঁকে বারবার কারাগারের অন্ধকার কে নিক্ষেপ করা হলেও এমনকি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় এক নম্বর আসামী করেও মতাশীলরা তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। দেশ মাতৃকার মুক্তি এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম ঠিকানা নিশ্চিত করতে তিনি অবিচল ছিলেন এবং দেশের মানুষ এই সত্যটি উপলব্দি করেছিল বলেই শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন অবিসংবাদিত নেতা-বঙ্গবন্ধু। ফলতঃ ১৯৭০ এর নির্বাচনে মানুষ এমনভাবে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর সমর্থনে, তাঁর এক আঙুলের ইশারায় ১৯৭১ সালের মার্চে একটি শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হতে পেরেছিল। মার্টিন লুথার কিং ও নেলসন ম্যান্ডেলার পরে বঙ্গবন্ধুই পৃথিবীর একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি অসহযোগ আন্দোলনকে সার্থক রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করতে পেরেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু’র জীবনের স্বপ্ন আর আকাক্সার এক বাস্তব প্রতিবম্ব ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্সে তাঁর জাদুকরী ও ছন্দময় কথামালার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। শৈশবের আবেগ কখন যে বিবেকে পরিণত হয়ে গেল তা নিজেও জানতেননা। তিনি মনে-প্রাণে যা বিশ্বাস করতেন তাই অনর্গল বলে যেতে লাগলেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ৭ মার্চ একটি স্মরণীয় অধ্যায়, একটি উদ্দীপনা জাগানো আর জাদুকরী ছন্দময় কথামালার নাম। যতরকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেণ-গবেষণা করা হোকনা কেন এর মর্মকথা দুটি হৃদয় নিংড়ানো বাক্যে প্রকাশ পেয়েছিল।

“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

বন্ধু-শুত্রু সবাই এর তাৎপর্য অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বাঙলার কৃষক, ছাত্র, আপামর জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাক শেয়াল শকুনদের বিরুদ্ধে। দৃশ্যপটে বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত অথচ প্রতি মুহূর্তে উজ্জীবীত বাঙালি উপলব্দি করেছে তাঁর অস্তিত্ব। আজ টুঙ্গিপাড়ার সমাধি থেকে বেরিয়ে এসে তিনি পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন সারা বাংলাদেশে। যে বাংলাদেশের তিনি স্থপতি, সেই বাংলাদেশের বস্তুতগত অর্জনের প্রশংসা আজ বিশ্বব্যাপী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত। তাঁর কাব্যময় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ অমিয় কথামালা আজ বিশ্বদরবারে গবেষণার উপাদান।

“আজ বাঙলার মানুষ মুক্তি চায়-তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পুর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামীলীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাঙলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস বাঙলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও মতায় বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খান ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রাখল। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেয়া হলো এবং এরপর এ অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হলো। বাঙলার নিরস্ত্র জনগণের ওপর অস্ত্র ব্যবহার করা হলো। —- আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলুন। —- যদি হুকুম দিবার নাও পারি — ।”

বঙ্গবন্ধুর এই ছন্দময় কথামালা আজও ধ্বনিত হচ্ছে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া ধ্বনিত হচ্ছে সবুজ শ্যামলিমার পথে প্রান্তরে। ধ্বনিত হচ্ছে বিশ্বের ন্যায়ত সংগ্রামী মানুষের রক্তে আর শিরা-উপশিরায়। আমার জন্ম স্বাধীনতার ১০ বছর পরে। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি। আজ স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরে আমার মায়ের কাছে সবিনয় জিজ্ঞাসা-সেদিন আমি কোথায় ছিলাম ? যেদিন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু রচনা করেছিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাটি। যার কবিতায় বাঙলার আকাশ-বাতাস-মাঠ-ঘাট প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল। শিহরণ জেগেছিল সমগ্র বাঙালির রক্তে। বাঙলার নিরস্ত্র কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক, জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি শেয়াল-শকুন আর হায়েনাদের বিরুদ্ধে। মা, তুমি বল, সেদিন আমি কোথায় ছিলাম? কোথায় ছিলাম সেদিন?

স্বাধীতনতার ৪৮ বছর পর আজ আমরা যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর স্লোগান তুলছি সেটি যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাঙলা‘র পরিবর্তিত রুপ তা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। এ নিয়ে আমাদের তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার সুযোগ কম। কেবল ‘সময়ের প্রয়োজনে’ বঙ্গবন্ধুর জীবন-যৌবন-আশা-আকাক্সার নির্যাস, সুনিপুণ স্বত্বা দিয়ে রচিত অকৃত্রিম স্বপ্ন ‘সোনার বাঙলা’ আজ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর রুপ পরিগ্রহ করেছে মাত্র। আমাদের মনে-প্রাণে-অন্তরে এমনকি এই রঙ কাঁচা বাঙলাদেশের রঙ পাকা হলেও বিশ্বাস রেখে কাজ করতে হবে এই ভেবে যে, তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি আছেন এবং থাকবেন বাঙালি জাতির সমস্ত স্বত্বা জুড়ে। যেকোনো ক্রান্তিকালে আমাদের অনুধাবন আর অনুভবে থাকতে হবে জাতির জনকের দৃপ্ত উচ্চারণ, ‘যদি হুকুম দিবার নাও পারি — — ।’ তাহলেই কেবল ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন অর্থবহ হবে। এর ব্যত্যয় হলে রাজনৈতিক মুক্তি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তথা সত্যিকার সোনার বাঙলা বিনির্মাণের সকল আয়োজন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

মো. আবুল কালাম আজাদ
বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতার্কিক
চেয়ারম্যান
ময়মনসিংহ ডিবেটিং সোসাইটি, ময়মনসিংহ।

akazaddebate@gmail.com