আধুনিক বাংলাদেশে অভিজ্ঞতার সম্পদ প্রবীণ নাগরিকদের সামাজিক উন্নয়নে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস

প্রকাশিত: ৭:২৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৪, ২০২০

ড. দেওয়ান রাশীদুল হাসান

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে রাষ্ট্র বা সরকার প্রবীণদের জন্য নানা ধরণের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশে সরকারী পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রবীণ সেবার পরিধি অত্যন্ত সীমিত, বেসরকারী প্রবীণ নিবাসগুলোর অধিকাংশই শোচনীয় অবস্থায়।

বৈশ্বিক মহামারি দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে অত্যান্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে । প্রবীণদের জন্য প্রতিরোধমূলক ও পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্য সেবা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারির সময় তাঁদের যথাযথ সুরক্ষা এবং সহায়তা প্রদান করা রাষ্ট্রীয় কর্তব্য।

যতবড় প্রতিষ্ঠান কিংবা রীতি-নীতি হোক না কেন আমাদের সমাজের মানসিকতা বদলায়নি কোনো অংশেই। প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক পারস্পরিক নির্ভরতার জন্য সর্বাগ্রে দৃষ্টিভঙ্গি ও মন মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। নবীণেরা প্রবীণদের কাছ থেকে উত্তম ও গঠনমূলক কাজের দীক্ষা লাভ করে। তাই প্রবীণের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে সফল ও সমৃদ্ধ করা দরকার।

১৯৩৮ সালে রাশিয়ায় বার্ধক্য নিয়ে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।  ইংরেজরা প্রবীণ ক্লাব গঠন করে প্রবীণদের উপযোগী কার্যক্রম পরিচালনা করে। জার্মানিতে প্রবীণদের জন্য বেশকিছু পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। জাতিসংঘ বার্ধক্য মোকাবিলায় অনেক আগে থেকেই রাষ্ট্রগুলোকে সচেতন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯৬৫ ও ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের কিছু কিছু আলোচনায় বার্ধক্য এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কথা উদ্বেগের সঙ্গে তুলে ধরা হয়।

১৯৮২ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রথমবারের মত বিশ্ব প্রবীণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বার্ধক্য সমস্যা মোকাবিলার প্রথম বিশ্ব উপকরণ হিসেবে এ সম্মেলনেই প্রণয়ন করা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল প্লান অব অ্যাকশন অন এইজিং। ১৪টি মূলনীতির আলোকে প্রবীণদের কল্যাণ বিধানের লক্ষ্যে ৬২টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, প্রবীণ ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ, আবাসন ও পরিবেশ, পরিবার, সমাজকল্যাণ, আয় ও কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন বিষয় এই সুপারিশগুলোতে স্থান পেয়েছিল।

১৯৯১ সালে জাতিসংঘ প্রবীণদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করে। ১৯৯৪ সালে উন্নয়নে প্রবীণদের সম্পৃক্তকরণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। ১৯৯৯ সালকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ বর্ষ হিসেবে ঘোষণা এবং সব বয়সীদের জন্য সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। যার মূল স্লোগান ছিল ‘বিশ্ব সমাজ হোক সকল প্রজন্মের। ২০০২ সালে স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্ব প্রবীণ সম্মেলন। ভিয়েনা কর্মমুখী পরিকল্পনাটিকে সক্রিয় ও গতিশীল করার উদ্দেশ্যে এই সম্মেলনে গৃহীত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রাটেজি অব অ্যাকশন অন এইজিং।

জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২৫নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছে যে, ‘প্রত্যেক মানুষেরই তার পরিবার-পরিজনসহ স্বাস্থ্য ও কল্যাণের নিমিত্তে জীবনমানের অধিকার রয়েছে। যেমন—খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা ও প্রয়োজনীয় সেবা কর্মসূচির সুযোগ এবং বেকারত্ব, অসুস্থতা, প্রতিবন্ধিতা, বৈষম্য, বার্ধক্য অথবা অনিবার্য কারণে জীবন ধারণে অন্যান্য অক্ষমতার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা লাভ।

 

বাংলাদেশে প্রবীণদের দারিদ্রমুক্ত, মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত কল্পে “জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা, ২০১৩” এবং “পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩”প্রণীত হলেও তাঁদের বাস্তব অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি । বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস জাতীয় রোগে ইউরোপ ও জাপানে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের প্রায় ৯৫ শতাংশের বয়স ৬০ বৎসরের বেশী, ৫০ শতাংশের বয়স ৮০ বৎসর বা তার বেশী । বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু সংক্রান্ত সঠিক পরিসংখ্যান সংরক্ষিত না থাকলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবীণ ব্যক্তি ইতোমধ্যেই করোনায় পরলোক গমন করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব মোঃ আবদুল করিম তাঁর এক নিবন্ধে সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন যে, করোনা প্রতিরোধে ছুটি, লক ডাউন ঘোষণা, ত্বরিত স্বাস্থ্য সেবা প্রদান এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহন করলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বয়, সিদ্ধান্তহীনতা, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্নীতি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে।

সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বরাদ্দ এ বছর যুক্তিসঙ্গতভাবে বাড়ানো হয়েছে যা দ্রুত ব্যয় করা প্রয়োজন। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় “প্রবীণদের জন্য সমন্বিত পেনশন পদ্ধতি“ চালুর বিষয়টি বিবেচিত হয়েছে যার আওতায় রয়েছে ষাট বছর বা তদূর্ধ্বে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বয়স্ক ভাতার প্রচলন, জাতীয় সামাজিক বীমা কর্মসূচি চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই, “বেসরকারী ভলান্টারী পেনশন“ ব্যবস্থা চালুর বিষয় রিভিউ করা ইত্যাদি।

বয়স্ক ও বিধবা ভাতা কর্মসূচিতে অনেক প্রবীণ ইতোমধ্যেই কিছুটা আর্থিক স্বস্তি পাচ্ছেন। এখানে দেশের বিরাট আকারের প্রবীণদের বাস্তব কল্যাণ বিধানে প্রবীণ দরদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ, অবদান এবং সাফল্য অত্যন্ত উজ্জ্বল।

আধুনিক সভ্যতার ইতিহাস ও পৃথিবীর সময়কে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সভ্যতার পতনের মধ্য দিয়ে প্রাচীন যুগের সমাপ্তি ঘটে। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে কারো জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষতা ছিল, কারো ছিল দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা। তবে যার যা-ই থাক না কেন, সব সভ্যতারই বৃহৎ বা ক্ষুদ্র অবদানে আশীর্বাদপুষ্ট আজকের এই আধুনিক সভ্যতা। আজ সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন প্রবীণ বয়সীরা।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এমন তথ্য মানুষের জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি তেমনই পরিসংখ্যান ফুটিয়ে তুলেছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে ষাটোর্ধ মানুষ বেশি। তাই প্রবীণদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নাজুক হওয়ার কারণে সতর্ক হয়ে চলার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বার্ধক্যের নানা সমস্যা সমাধানে নিজেকেই সচেতন থাকতে হবে। নিজেকে বৃদ্ধ না ভেবে সুস্থ সবল ভাবাই শ্রেয়। সব সময় নিজেকে কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে।

এখানে সবিশেষ উল্লেখ্য, করোনায় প্রবীণদের মৃত্যু নিয়ন্ত্রণহীন। দেশে করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) প্রবীণদের মৃত্যুর মিছিল থামছেই না।

গত ১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩২ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এ ভাইরাস। ফলে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে পাঁচ হাজার ২৫১ জনে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, করোনায় মোট মৃতদের মধ্যে ৫১ শতাংশই প্রবীণ অর্থাৎ ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ। তবে রোগতত্ত্ব ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবীণরা শুধু করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হওয়ার কারণে মারা যাচ্ছেন এমন নয়। তারা আগে থেকেই বার্ধক্যজনিতসহ নানা অসংক্রামক রোগে (ক্যানসার, কিডনি সমস্যা, লিভার, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) আক্রান্ত থাকায় তাদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে।

অন্য দিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে যে পারিবারিক বন্ধন, আর্থসামাজিক বন্ধন, বাস্তবতা এবং প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণেই বাংলাদেশে প্রবীণরা ভালো আছে। কাউকে ফেলে রেখে নয়, বরঞ্চ সকলকে নিয়ে বিশ্বসমাজের প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির অভিযাত্রা চলমান রাখতে হবে৷ করোনা ভাইরাসের গজব থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীকে আল্লাহ পাক মুক্তি দিন। মরন ব্যাধি করোনার কোন প্রতিষেধক নাই। এ রোগ থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কোন উপায় নাই।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১ অক্টোবর দেশব্যাপী বিশ্ব প্রবীণ দিবস পালিত হয়। ১৯৯১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪৫/১০৬ নং রেজুলেশন অনুযায়ী অক্টোবরের প্রথম দিনটি ‘বিশ্ব প্রবীণ দিবস’হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। প্রবীণ ব্যক্তিরা যাতে সম্মান, মর্যাদা ও তাদের অধিকার নিয়ে পরিবার-সমাজে বসবাস করতে পারেন, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন এবং তাদের যাতে কেউ অবহেলা বা অসম্মানের চোখে না দেখেন সে বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই এ দিবসটি পালিত হয়।

আমাদের রাজনৈতিক নেতারা, সরকার প্রধান, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, স্পিকারসহ নেতৃস্থানীয় অধিকাংশই প্রবীণ। কাজেই তারা প্রবীণদের সামাজিকভাবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান, সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার বিষয়ে দ্রুত এগিয়ে আসবেন এবং প্রবীণদের কল্যাণে সাহায্যের হাত প্রসারিত করবেন-প্রবীণ দিবসে দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর এটাই প্রত্যাশা। এ বছর জাতিসংঘের ৭৫তম বার্ষিকী ও আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের ৩০তম বার্ষিকী চলছে।

আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস  উপলক্ষে এ বছরের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, “Pandemics: Do They Change How We Address Age and Ageing “? এর আলোকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাংলা প্রতিপাদ্যঃ “বৈশ্বিক মহামারীর বার্তা, প্রবীণদের সেবায় নতুন মাত্রা। ” আমরা বর্তমানে স্মরণকালের ভয়াবহ মহামারী অতিক্রম করছি। এ মহামারীতে, তুলনামূলকভাবে প্রবীণ জনগোষ্ঠী অধিক হারে আক্রান্ত হচ্ছে।

এ প্রেক্ষাপটে, এ বছরের নির্ধারিত স্লোগান অর্থবহ ও যথার্থ।  আমরা লক্ষ্য করছি, বিশ্বব্যাপী প্রবীণ জনসংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯৫ সালের ৫৪ কোটি প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৫ সালে ১২০ কোটি এবং ২০৫০ সালে প্রায় ২০০ কোটিতে দাঁড়াবে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রবীণ জনসংখ্যা প্রায় ১.৫ কোটি যা’ ২০২৫ সালে ২ কোটি এবং ২০৫০ সালে প্রায় ৪.৫ কোটিতে বৃদ্ধি পাবে। এর মধ্যে উদ্বেগজনক হচ্ছে, এই বর্ধিত প্রবীণ জনসংখ্যার মধ্যে অতি প্রবীণদের (৮০+) সংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব সূদুর প্রসারী।

২০২০ থেকে ২০৩০ সালকে ডিকেড অ্যান্ড হেলদি এজ হিসেবে পালন করা হবে বাংলাদেশেও। দশকটিতে প্রবীণ স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে তাদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি অগ্রাধিকার হিসেবে সুলভে বা বিনা ব্যয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিও নিশ্চিত করতে হবে।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় প্রবীণ নীতি বাস্তবায়ন হয়েছে অনেক আগেই। শ্রীলংকা এ ব্যাপারে অনেক এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের উচিত ২০১৩ সালের প্রবীণ নীতিটি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা, এটিকে সাত বছর ঝুলিয়ে রেখে, প্রবীণদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে তাদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে। ঢাকায় প্রবীণ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রতিটি জেলা-উপজেলা হাসপাতালে সার্বক্ষণিক আলাদা ওয়ার্ড বা বেড নিশ্চিত করতে হবে। তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কর্মে নিয়োগ দিতে হবে।

সক্ষম প্রবীণদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কোনো অংশে কম নয়, এতে দেশ উপকৃত হবে। প্রবীণদের অবসর বিনোদনের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি রাষ্ট্রের দায়িত্ব আর এসব কাজে প্রবীণদের সম্পৃক্ত করেই সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৫৯ বছর। বাংলাদেশ সরকার দেশের ৬০ বছর ও তার অধিক বয়সীদের ‘জ্যেষ্ঠ নাগরিক’ বা ‘ সিনিয়র সিটিজেন’ ঘোষণা করে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রবীণদের অবদান অসীম।

বিগত ১৪ জুলাই ২০১৮ রাজধানী ঢাকায় একটি বেসরকারি, অবৈতনিক, অরাজনৈতিক, অলাভজনক, অসাম্প্রদায়িক স্বেচ্ছাসেবী প্রবীণ নাগরিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেন ফোরাম’ (Bangladesh Senior Citizen Forum-BSCF) নামে একটি ফেসবুক ভিওিক সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে প্রায় দুই বছরের ব্যবধানে প্রবীণ সদস্যদের সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। এ

কুশ শতকের প্রবীণদের জীবন যাপনে সহায়তা ও বিশ্ব সিনিয়র সিটিজেন সম্প্রদায় গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগঠনটি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন প্রবীণ রয়েছে যাদের বয়স ৬০ কিংবা তার ঊর্ধ্বে। এমনকি ধারণা করা হচ্ছে যে, ২০৩০ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ১.৪ বিলিয়ন এবং ২০৫০ সালে হবে ২ বিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। গবেষণা আরও বলছে, প্রবীণদের সংখ্যা উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে বাড়ছে।

প্রতিষ্ঠাতা অবৈতনিক সদস্যসহ আমাদের সকলের ভালোবাসার পরিবার ‘বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেন ফোরাম’। আমরা জেনেছি, প্রবীণ নীতিমালার আলোকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিতে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে সরকার।

জ্যৈষ্ঠ নাগরিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশে অবস্থিত প্রবীণদের বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি বাংলাদেশে সিনিয়র সিটিজেন ফোরাম সংশ্লিস্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। অর্থনৈতিক মুক্তি প্রবীণদের ক্ষমতায়ন করে। আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি।

 

রাষ্ট্র একটি দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি। তাই প্রবীণদের সমস্যা সমাধানে ব্যক্তি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ যতটা কার্যকর, তারচেয়েও অধিক কার্যকর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। প্রবীণদের সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্র যতটা সহজে নিশ্চিত করতে পারে, তা’অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। একজন প্রবীণ যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী থাকেন, তবে তাঁর সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যায়।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সরকারিভাবে অবসর ভাতা, বয়স্ক ভাতা এবং বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুস্থ নারীদের ভাতা প্রদান কার্যক্রম প্রবীণদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছে। কিন্তু যদি ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়, তবে তা’  আরো উপকারে আসবে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে প্রবীণ বয়সে সঠিক চিকিৎসা সেবা পাওয়াও সবার জন্য সহজ নয়।

দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার চিত্র অনুসারে সুচিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক নিয়মে সবাই একসময় প্রবীণ হবে। তাই প্রবীণদের প্রতি সবার যত্নবান হওয়া উচিত। জাতীয় ঐক্য ও দেশপ্রেম যে কোন সংকট উত্তরণের ক্ষেত্রে মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে।  তাই, জাতীয় স্বার্থেই প্রকৃত চিএ তুলে ধরা ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের প্রবীণদের নিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

নবীণ-প্রবীণের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও ভক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে পৃথিবীতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হয়,  যেখানে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের স্ব-স্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।তবে এ প্রসঙ্গে  আমাদের মনে রাখতে হবে যে, দেশের সমাজ ব্যবস্থা একা পরিবর্তন করা যায়না, এগিয়ে আসতে হবে প্রবীণ জনসাধারণকেও। অভিজ্ঞতার আলোকে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের জন্য দরকার সামাজিক আন্দোলন । একই রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে থাকা সত্ত্বেও সমাজের চেহারা এক নয়, বহু । প্রবীণদের অসহায়ত্ব দূর করতে সামাজিক, পারিবারিক  ও  মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে আমাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে, যেতে হবে অনেক দূর। প্রবীণদের অবজ্ঞা নয় তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। আশার কথা, বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেন ফোরামের সম্মানিত সদস্যরা সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে  সামনে রেখে প্রবীণদের বিশেষ মর্যাদায় উন্নীতকরণ ও তাঁদের স্বার্থ সংরক্ষণে সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, ০১ অক্টোবর ২০২০ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে ফোরামের সদস্য সংখ্যা ছিল ৮,১৭২ জন। প্রকৃতপক্ষে, প্রবীণ ব্যক্তি বা সিনিয়র সিটিজেন হলেন আমাদের পথ প্রদর্শক। গভীর ও বিস্তৃত জ্ঞানের অধিকারী এই প্রবীণরা অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের উপকার করে থাকেন। প্রবীণরা আমাদের আপনজন। নি:স্বার্থভাবে প্রবীণরা সদস্যরা যে যখনই সময় পায়, তক্ষুণি ‘বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেন ফোরামের সার্বিক কল্যাণে নিবিড়ভাবে নিরলসভাবে কাজ করে। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবের। আমরা সবাই নিজের পকেটের টাকা খরচ করে, মূল্যবান সময় ও শ্রম ব্যয় করে, প্রবীণদের এই সংগঠনটি দাঁড় করিয়েছি। সম্মিলিত সকল সদস্যের সাহায্য সহযোগিতায় আশা করি, ইনশা’আল্লাহ, প্রবীণদের বর্তমান সমস্যা অদূর ভবিষ্যতে দূর হবে।

বাংলাদেশের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় আমাদের দেশের অবহেলিত জনগণের জন্য কাজ করে। প্রবীণদের গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহারে বর্তমান সরকার প্রবীণদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রহণের কথা উল্লেখ্ করেছে। তাঁদের আয় ও কর্মক্ষম করে তোলার বিষয়টা নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সমস্ত পৃথিবী পরিবর্তিত হচ্ছে। দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন খুব প্রয়োজন। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে সমাজকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। যেখানে আমরা কেবল প্রবীণদের সম্মান দেওয়া নয়, তাঁদের অভিজ্ঞতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব। ভবিষ্যতে প্রবীণের সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু অতি প্রবীণের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি বাড়বে।

পরিশেষে বলতে হয়, একজন সুস্থ বিবেক ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ তার বৃদ্ধ বাবা-মা এবং তার আত্মীয়-পরিজন ও অন্য প্রবীণদের কখনো অবহেলা বা উপেক্ষা করতে পারে না। বর্তমানে  ডিজিটাল সুবিধার পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্রে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য করণীয় ঠিক করতে হবে। দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হলে যেমন হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া উচিত নয়, তেমনি সুখের সময়ও তাতে ডুবে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

মানুষের মাঝে ধৈর্যের অভাব থাকলে অনুপ্রেরণা আর অনুশীলনের মাধ্যমে সে এই গুণটি অর্জন করতে পারে। আমাদের ধৈর্যধারণ করে সহনশীলতার সঙ্গে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য কাজ করে যেতে করতে হবে। প্রাক্তন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি জন কুইন্সি অ্যাডামস (১৮২৫-২৯) “Patience and perseverance have a magical effect before which difficulties disappear and obstacles vanish.” অতএব, প্রবীণদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পথের সন্ধানে সদা জাগ্রত থেকে বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেন ফোরামের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে আমাদের ধৈর্যধারণ করে সহনশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে সিনিয়র সিটিজেনদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে সামাজিক শক্তির বড় জাগরণ প্রয়োজন।

লেখক : সার্ক স্কলার, প্রশিক্ষক, গবেষক, প্রাবন্ধিক, খ্যাতিমান গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, প্রবীণ সাংবাদিক এবং সাবেক ডাইরেক্টর (জনসংযোগ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ