জাতির জনকের প্রজ্জ্বলিত দীপ্তশিখা ছড়িয়ে যাক মাঠ-প্রান্তর-আকাশে-বাতাসে-মো. আবুল কালাম আজাদ

মুজিব বর্ষ

প্রকাশিত: ৮:২২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৩০, ২০২০

 

‘শতবর্ষের সাী তুমি হে মহান
জন্ম তোমার ইতিহাস হবে
দেশ হবে মহীয়ান
তুমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান—-।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটে প্রাণ না হারাতেন তবে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ তিনি শতায়ু হতেন। আবার কাকতালীয়ভাবে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে বাংলাদেশ তাঁর স্বাধীনতার অর্ধ-শত বার্ষিকীতে পদার্পণ করবে।

কি আশ্চর্য এক মিলের সেতু বন্ধন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্বপ্নের গড়ে ওঠা বাংলাদেশের। কিন্তু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালিকে জাতি হিসেবে আমরা মাত্র ৫৫ বছর ৪ মাস বাঁচতে দিয়েছি। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে তিনি শতায়ু হতেন না কে বলতে পারে। যদি তিনি তাঁর অতি প্রিয় বাঙলার মাটিতে শতবর্ষ বেঁচে থাকতেন তবে এই দিনটি জাতি তখন কীভাবে পালন করত, তা ভাবলে মনে-প্রাণে শিহরণ জাগে।

সেই উপলব্দি থেকেই হয়তো বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার সে দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপল্েয ২০২০-২০২১ খ্রিস্টাব্দকে মুজিববর্ষ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে। এই হল পটভূমি। যে দেশটির জন্য তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন, যে দেশের ভাগ্যের উন্নয়নের কথা নিয়েই যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আতœনিয়োজিত ছিলেন, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঘোষিত ‘মুজিববর্ষ’টি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

‘জয় বাঙলা’ — এ স্লোগান আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাইতো গত ১০ ডিসেম্বর ২০১৯ ‘জয় বাঙলা’ কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা দেন মহামান্য হাইকোর্ট। আর এই স্লোগান যার মুখে মুখরিত ছিল তিনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় সংগ্রামী বাঙালির প্রিয় নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

যাঁর নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ অভিজাত এক বংশে শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুনের ঘরে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে শিশু। বাবা-মা আদর করে নাম রাখলেন ‘খোকা’। টুঙ্গিপাড়ার একটি বনেদী পরিবারের নাম শেখ পরিবার। এই পরিবারের উত্তরসূরী শেখ পরিবারের সুপরিচিত ব্যক্তি শেখ হামিদ গড়ে তোলেন একটি টিনের ঘর। শেখ হামিদের একমাত্র পুত্র শেখ লুৎফর রহমান একজন সজ্জন ব্যক্তি।

এখানে ১৯৭৪ সালের কথা প্রনিধানযোগ্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৫৪ তম জন্মদিন পালিত হলো বাঙলার আকাশে দুর্যোগের এক গভীর ঘনঘটার মধ্যে। তিনি তখন ছিলেন গুরুতর অসুস্থ। মাত্র দুদিন পর চিকিৎসার জন্য মস্কো যাবেন, এই খবরটা মানুষ তখন জেনে গেছে। এই নিয়ে গভীর শঙ্কা মানুষের মনে। বঙ্গবন্ধুর সুস্থতা কামনা করে বয়স্ক মানুষ বিশেষত মা-দাদিরা রোজা রাখছেন, এই খবর তখন পত্রপত্রিকাসহ জানা যাচ্ছিল।

বঙ্গবন্ধুর শৈশব :

বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমামন্ডিত টুঙ্গিপাড়ায়। টুঙ্গিপাড়া গ্রামেই শেখ মুজিবুর রহমান ধনধান্যে পুস্প ভরা শস্য শ্যামলা রূপসী বাঙলাকে দেখেছেন। তিনি আবহমান বাঙলার আলো বাতাসে লালিত-পালিত ও বেড়ে উঠেছেন। তিনি দোয়েল ও বাবুই পাখি ভীষণ ভালোবাসতেন। বাড়িতে শালিক ও ময়না পুষতেন। আবার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন বোনদের নিয়ে। পাখি আর জীবজন্তুর প্রতি ছিল গভীর মমতা। মাছরাঙা ডুব দিয়ে কীভাবে মাছ ধরে তাও তিনি খেয়াল করতেন খালের পাড়ে বসে বসে। ফুটবল ছিল তাঁর প্রিয় খেলা। এভাবে তাঁর শৈশব কেটেছে মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে আর বর্ষার কাদা পানিতে ভিজে। গ্রামের মাথ-ঘাট-মেঠো পথ আর মানুষ তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতো।

বঙ্গবন্ধুর পড়াশুনা :

বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান আদালতে চাকরি করতেন। তাঁর মাতা সায়েরা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে তিনি একজন বিজ্ঞ আইনজীবী হবেন। টুঙ্গিপাড়ার সেই শেখ বাড়ির দেিণ ছিল কাছারি ঘর। এখানেই মাস্টার, পন্ডিত ও মৌলভী সাহেবদের কাছে ছোট্ট মুজিবের হাতেখড়ি। একটু বড় হলে তাদের পূর্ব পুরুষদের গড়া গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। এরপর পিতার কর্মস্থল মাদারীপুরের ইসলামিয়া চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে কিছুদিন লেখাপড়া করেন।

পরবর্তীতে তাঁর পিতা বদলী হয়ে গোপালগঞ্জে যোগদান করলে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। বিদ্যালয়ের প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন তিনি। পছন্দ করতেন ইতিহাসের বই। এসব কারণে প্রধান শিক গিরিশ চন্দ্রসহ সকল শিকের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিব। শিশুকাল থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন পরোপকারী এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী। মানুষের দুঃখ দুর্দশায় যেমন সহযোগিতার হাত বাড়াতেন-তেমনি কারো প্রতি অন্যায় আচরণ দেখলে প্রতিবাদ করতেন। মাত্র তের বছর বয়সে প্রতিবাদের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর নৈতিকতাবোধ :

বঙ্গবন্ধু শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে গভীরভাবে প্রত্য করেছেন। শৈশব থেকে তৎকালীন সমাজ জীবনে তিনি জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজা নিপীড়ন দেখেছেন। গ্রামের হিন্দু, মুসলমানদের সম্মিলিত সামাজিক আবহে তিনি দীা পান অসাম্প্রদায়িকতার। আর পড়শি দরিদ্র মানুষের দুঃখ, কষ্ট তাঁকে সারাজীবন সাধারণ দুঃখী মানুষের প্রতি অগাধ ভালবাসায় সিক্ত করে তোলে।

বস্তুতপে সমাজ ও পরিবেশ তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি কোন শক্তির কাছে — সে যত বড়ই হোক, আতœসমর্পণ করেননি, মাথানত করেননি। অবিভক্ত বাঙলার প্রধানমন্ত্রী শের ই বাঙলা এ কে ফজলুল হক একবার তাঁদের স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর সাহসিকতার মুগ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের স্কুল মেরামতের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন।

বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা :

বঙ্গবন্ধু ছোটদেরকে ভীষণ ভালোবাসতেন। কচিকাঁচার মেলা ও খেলাঘর ছিল তাঁর প্রিয় সংগঠন। কৈশোরে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কচিকাঁচার আসরে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের শেষ দিনটি তিনি কাটিয়েছেন এই সংগঠনের ভাই-বোনদের মাঝে। তাঁর জন্মদিনটিকে এখন আমরা জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করি। শিশুদের কাছে দিনটি আনন্দ-খুশির।

এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটি তাঁর ১০০তম জন্মবার্ষিকী। এবছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পূর্ণ হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন আমাদের জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। দিনটিকে সামনে রেখে শিশুদের তৈরি করার বিষয়টি আমাদের সামনে এসে যায়। বঙ্গবন্ধু যেভাবে শৈশব-কৈশোর নানা ধরণের মানবিক চেতনাবোধে বড় হয়েছেন, আমাদের শিশুদের মাঝে এ চেতনা বিস্তার লাভ করুক- এটাই এ সময়ের প্রত্যাশা।

তিনি যেভাবে বন্ধুদের সঙ্গে আন্তরিক সহমর্মিতায় নিজের কিশোর বেলা পার করেছেন, সেটা আমাদের কিশোর-কিশোরীদের জন্য একটি বড় দিগন্ত। ওরা যদি বড় হয় তাহলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ মানবিক দর্শনে রূপান্তরের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র হবে। এখন প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগের মধ্যে বিষয়গুলো শিশুদের শেখানো।

সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফরে এসে বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করেছে ‘বিশ্বনেতা’ হিসেবে, যা অনুসরণীয় হতে পারে অন্যান্য দেশের। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ একটি প্রকল্প। বাস্তবায়িত হচ্ছে নদীগর্ভে ৩.৬৬ কিলোমিটার ট্যানেল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ ১০ টি মেগা প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর কপথ।

আর এসব যার সুনিপুণ হাত ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছে তিনি আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা আমাদের বর্তমান মাননীয় মানবিক প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। এও ইতিহাসের এক অমোঘ সত্য যে, জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ তথা মুজিববর্ষ উদযাপিত হচ্ছে তাঁরই কন্যার হাত ধরে। এবারের এই বর্ষকে ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় করতে, জাতির জনকের প্রজ্জ্বলিত দীপ্তশিখা তথা সমুজ্জ্বল আলো বাঙলার ঘরে ঘরে ছড়াতে বাঙালির এবারের অঙ্গীকার ছড়িয়ে যাক বাঙলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তর, আকাশে-বাতাসে এই আমাদের প্রত্যাশা। জয় বাঙলা।

লেখক

মো. আবুল কালাম আজাদ
বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতার্কিক
চেয়ারম্যান, ময়মনসিংহ ডিবেটিং সোসাইটি, ময়মনসিংহ।