মহান মুক্তিযুদ্ধকে আরও বেশি বেগবান করতে স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা অপরিসীম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর হামলা শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সক্রিয় হয়েছিল বিপবী স্বাধীন বাঙলার বেতার কেন্দ্র।
এই বেতার কেন্দ্র থেকে শুধু পাকিস্তানি স্বৈর শাসকের চ্যালেঞ্জই গ্রহণ করেনি, সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল বিশ্বের সমর্থন এবং সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছিল।
স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের ঐতিহাসিক নাম ঘোষণা এক মুহূর্তে ধসিয়ে দিয়েছিল দাম্ভিক ইয়াহিয়ার প্রতিরোধহীন বিজয় দর্পকে। এই বেতার কেন্দ্র, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং শোকাভিভূত লাখো বাঙালির মনে সঞ্চার করেছিল আশার আলো।
এই বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শুনা মাত্র বহু বাঙালি অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। সে অশ্রু ছিল আনন্দের, স্বস্থির, গৌরবের। বাঙালি উঠে দাঁড়ালো গভীর আতবিশ্বাসে। বীর বঙ্গশার্দূলগণ পেলেন শত্রুর ওপর আঘাত হানার নতুন প্রেরণা।
২৬ ও ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এল একটি বিদ্রোহী কণ্ঠ। প্রায় পাঁচ মিনিটকাল স্থায়ী এই কণ্ঠে ছিল বাঙলার জনগণের প্রতি দখলদার বাহিনীকে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ানোর উদাত্ত আহ্বান। ২৬ ও ২৭ মার্চ ১৯৭১ এই স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তেজোদ্বীপ্ত ভাষায় পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে দিয়েছিলেন নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী। এই বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমেই পৃথিবীর জাতিসমূহের কাছে জানানো হয়েছিল বাংলাদেশের প্রতি তাৎণিক স্বীকৃতি এবং সহযোগিতা দানের আহ্বান।
প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার বিপবী স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র সংগঠিত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের দশজন নিবেদিত কর্মী (দুজন বেতার কর্মী ছিলেন না), স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, জনগণ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহযোগিতায়। এই বিপবী বেতার কেন্দ্রের দশজন সার্বণিক সংগঠক ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ (উক্ত বেতারের নিজস্ব শিল্পী), আবুল কাশেম সন্দ্বীপ (ফটিকছড়ি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল), সৈয়দ আব্দুস শাকের (চট্টগ্রাম বেতারের প্রকৌশলী), আব্দুলাহ আল ফারুক (অনুষ্ঠান প্রযোজক), মোস্তফা আনোয়ার (অনুষ্ঠান প্রযোজক), রাশেদুল হোসেন (টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট), আমিনুর রহমান (টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (টেকনিক্যাল অপারেটর) এবং কাজী হাবিবুদ্দিন (বেতার কর্মী ছিলেননা)।
বিপবী স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ; এই বেতার কেন্দ্রের প্রথম অধিবেশন সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন আবুল কাশেম সন্দীপ, স্থানীয় বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার মনজুলা আনোয়ার, ডাক্তার সৈয়দ আনোয়ার আলী, ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলাম, দিলীপ চন্দ্র দাশ, কাজী হোসনে আরা প্রমুখ। কিন্তু শেষোক্ত চারজন প্রথম সন্ধ্যার ঐতিহাসিক অধিবেশন শেষে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ছেড়ে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেনি। উলেখ্য যে, উদ্বোধনী অধিবেশনের সময় কাজী হোসনে আরা কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও বিপবী স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের অবস্থান গোপন রাখার জন্য নিরাপত্তাজনিত কারণে কণ্ঠ দিতে পারেননি।
বিপবী স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের সার্বণিক প্রথম দশজন সংগঠন কর্মীকে প্রত্যভাবে আরও যারা সহযোগিতা প্রদান করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডাক্তার মোহাম্মদ শফি (শহীদ), মুশতারী শফি, মীর্জা নাসির উদ্দিন (চট্টগ্রাম বেতারের আঞ্চলিক প্রকৌশলী), সুলতান আলী (বার্তা স¤পাদক), আব্দুস সোবহান (বেতার প্রকৌশলী), দেলোয়ার হোসেন (বেতার প্রকৌশলী), মাহমুদ হোসেন (শহীদ), আব্দুস শুকুর, সেকান্দার হায়াত খান প্রমুখ। এছাড়া যাদের পরো সমর্থন এই বেতার সংগঠনে বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছিল তাদের মধ্যে চট্টগ্রাম বেতারের সহকারি আঞ্চলিক পরিচালক আব্দুল কাহহারের নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে উলেখযোগ্য।
স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার বাধাহীনভাবে এগুতে পারেনি। প্রচন্ড বাধা এসেছিল মাত্র চারদিনের মধ্যে। শত্রুর বোমারু বিমান থেকে ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে বোমা ফেলা হয়। উপায়ন্তর না দেখে বাংলাদেশের বীর শব্দ সৈনিকগণ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর সহায়তায় একটি ুদ্র ১ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার বয়ে নিয়ে আসেন মুক্তাঞ্চলে। এই ট্রান্সমিটারের সাহায্যে বিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল আরও কিছুদিন।
মুজিব নগর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আতœপ্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধের প্রচার জোরদার করার উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রকে নতুন করে সংগঠনের দায়িত্ব অর্পিত হয় আব্দুল মান্নান এম. এন. এ‘র ওপর। মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৩৭৮ সালের ১১ জ্যেষ্ঠ, ১৯৭১ সালের ২৫ মে ছিল মঙ্গলবার। এইদিন ঠিক সকাল ৭ টায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাঙলার আকাশে ইথার তরঙ্গে ভেসে এলো এক নতুন বেতার কেন্দ্রের সঙ্কেত ধ্বনি। যন্ত্রসঙ্গীতে ‘জয় বাঙলা, বাঙলার জয়’।
প্রথম অনুষ্ঠানে আরও যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা হলেন — উদ্বোধনী ও অনুষ্ঠান স¤পর্কিত ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধুর বাণী থেকে পাঠ : আশাফাকুর রহমান খান (বেতার কর্মী)। পবিত্র কুরআন তেলওয়াত : মোহাম্মদ উলাহ চৌধুরী (সাংবাদিক)। বাঙলা খবর গ্রন্থনা : কামাল লোহানী (সাংবাদিক)। বাঙলা খবর পাঠ : সৈয়দ হাসান ইমাম (অভিনেতা)। ইংরেজি সংবাদ গ্রন্থনা : আলী যাকের (নাট্যকর্মী ও অভিনেতা), এ কে জালাল উদ্দিন (সাংবাদিক)। ইংরেজি সংবাদ পাঠ : মিসেস টি হোসেন (গৃহবধূ)। চরমপত্র রচনা ও পাঠ : এম. আর. আখতার মুকুল (সাংবাদিক ও প্রবন্ধকার)। জাগরণী গানের অনুষ্ঠান : তাহের সুলতান (বেতার কর্মী), টি এইচ সিকদার (বেতার কর্মী)। পূর্ণ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে শুরু হয়েছিল এই বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার।
স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের কাজ পরিচালিত হতো ছোট একটি দ্বিতল বাড়িতে। অনুষ্ঠান বাণীবদ্ধ করার জন্য স্টুডিও ছিল মাত্র একটি। পরে আরও একটি ক খালি করে অনুষ্ঠান রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থা হয়েছিল। তবে এগুলোতে পেশাগত স্টুডিওর ন্যায় কোন শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিলনা। ছিলনা প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রী। অবশ্য পরবর্তীকালে বাদ্যযন্ত্রের আংশিক অভাব পূরণ হয়েছিল। দায়িত্বপ্রাপ্তরা ড্রাম, সাইড ড্রাম, গীটার, করনেট ইত্যাদি যন্ত্রপাতি খরিদ করে নিয়েছিলেন। দায়িত্বপ্রাপ্তদের বাড়ির ব্যবস্থা ছিলনা। ওখানেই তারা খাওয়া-দাওয়া করতেন। সারাদিন এবং গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে ঐ বাড়ির খোলা মেঝেতেই চাদর পেতে শুয়ে পড়তেন। সীমিত কয়েকজন লেখক, কথক এবং শিল্পী নিয়ে শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের সাথে জড়িত ছিলেন, তাঁরাও মুক্তিযুদ্ধের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে তাদের নাম স্বর্ণারে লিখা থাকবে চিরকাল।
লেখক
মো. আবুল কালাম আজাদ
বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতার্কিক
চেয়ারম্যান, ময়মনসিংহ ডিবেটিং সোসাইটি, ময়মনসিংহ।
ব্যাংক কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মী।