ময়মনসিংহের ১১ আসনে ১০টি আসনেই নৌকা-লাঙ্গলে স্বতন্ত্র বাধা

মাত্র ১টি আসনে নির্ভার আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ৯:২৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩

স্টাফ রিপোর্টার, গফরগাঁও :

ময়মনসিংহ জেলা জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারের ডামাডোল। এ জেলায় ১১টি সংসদীয় আসন। ১টি সিটি কর্পোশেন, ১৩ টি উপজেলা, ১০ টি পৌরসভা ও একটি ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এলাকা নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার ১১টি আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ৯১টি।

স্থানীয় রাজনীতির নানা সমীকরন বিবেচনা নিয়ে এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাটি হিসেবে পরিচিত ময়মনসিংহ জেলার ১১টি আসনের মধ্যে ৮টি আসনেই ‘আওয়ামী লীগের’ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শক্ত প্রতিদ্বন্ধিতার মুখে পড়তে হতে পারে নৌকার প্রার্থীদের। দুইটি আসন আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিয়েছে জাতীয় পাটিকে। সেই দুই আসনেও জাতীয় পাটির প্রার্থীদের সামনে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে ‘আওয়ামী লীগের’ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এই ১০টি আসনেই জমজমাট ভোটযুদ্ধের আভাস মিলছে। মাত্র একটি আসন ময়মনসিংহ-১০ আসনে নৌকার প্রতীকের প্রার্থী ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল জয়ের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত বেশ ‘নিভার’।

ময়মনসিংহ-১ (১৪৬) আসন : হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলা নিয়ে ময়মনসিংহ-১ আসন। এই আসনে মোট ৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধি¦তা করছেন। শক্ত প্রতিদ্বদ্ধিতা হবে নৌকা প্রাথী জুয়েল আরেং এর সাথে স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহমুদুল হক সায়েমের। জুয়েল আরেং তার পিতা সাবেক মন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের মৃত্যুর ২০১৬ সালে উপ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। তার পিতা প্রমোদ মানকিন এ আসন থেকে ১৯৯১, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহমুদুল হক সায়েম হালুয়াঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রার্থী হয়েছেন। তার পিতা এমদাদুল হক মুকুল এই আসনের সাবেক এমপি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। জুয়েল আরেং এর আদিবাসিদের একটি ভোট ব্যাংক আছে আবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ায় সায়েম এর বোটের পাল্লাও কম ভারী নয় স্থানীয়রা মনে করছেন।

ময়মনসিংহ-২ (১৪৭) আসন : ফুলপুর ও তারাকান্দা উপজেলা নিয়ে ময়মনসিংহ-২ আসন। এই আসনের শক্ত প্রতিদ্ব›িদ্ধ গৃহায়ন ও গনপূর্ত মন্ত্রী নৌকা মার্কা প্রতীকের শরীফ আহম্মেদ ও সাবেক এমপি, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি থেকে বহিস্কৃত নেতা ঈগল মার্কা প্রতীকের শাহ শহীদ সারোয়ার। শরীফ আহমেদ দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদে এই আসন থেকে নির্বাচিত এমপির ছিলেন। শাহ শহীদ সারোয়ার ২০০১ সালে এই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই শাহ শহীদ সারোয়ার এই আসনের শক্তিশালি প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থী।

ময়মনসিংহ-৩(১৪৮) আসন : গৌরিপুর উপজেলা নিয়ে ময়মনসিংহ -৩ আসন। মোট ৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন। হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্ধিতা হবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নৌকা মার্কা প্রতীকের নিলুফার আনজুমের সাথে স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রাক মার্কা প্রতীকের উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সোমনাথ সাহার। গৌরিপুর উপজেলা মেয়র, পৌর মেয়র ও ৬ জন ইউপি চেয়ারম্যান নৌকার পক্ষে নির্বাচন করলেও ৩ জন ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী সভাপতি এবং সাধারন সম্পাদকের ২২ জনের ২০ জনই ট্রাক মার্কা প্রতীকের সর্মথনে নির্বাচন করছে।

ময়মনসিংহ-৪ (১৪৯) আসন : ময়মনসিংহ সিটি কর্পোশেন ও সদর উপজেলা নিয়ে ময়মনসিংহ -৪ আসন। এই আসনে মোট ১০ জন প্রার্থী। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই নৌকা মার্কা প্রতীকের মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মোহাম্মদ মোহিত উর রহমান শান্ত’র সাথে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ট্রাক মার্কা প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ আমিনুল হক শামীমের। এ আসনে বিএনপির সাবেক নির্বাহী কমিটির সদস্য, সাবেক এমপি ও সাবেক পৌর মেয়র কাঁচি মার্কা মার্কা প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোঃ দেলোয়ার হোসেন দুলুও শক্ত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী মাঠে আছেন।

ময়মনসিংহ-৫ (১৫০) আসন : মুক্তাগাছা উপজেলা নিয়ে ময়মনসিংহ-৫ গঠিত। মোট ৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন। আওয়ামী লীগ এ আসনটি জাতীয় পাটিকে ছেড়ে দিয়েছে। শক্ত প্রতিদ্বন্ধিতা হবে জাতীয় পাটির প্রার্থী লাঙ্গল মার্কা প্রতীকের সাবেক এমপি সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তির সাথে কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রাক মার্কা প্রতীকের কৃষিবিদ নজরুল ইসলামের। স্থানীয়রা স্বজনকে জানায়, এই আসনে জাতীয় পাটির প্রার্থীকে সর্মথন দেওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। বর্তমান এমপি ও সরকারের মন্ত্রী কে এম খালিদ বাবুর নেতৃত্বে উপজেলা আওয়ামী লীগের একটি লাঙল মার্কাকে সর্মথন দিচ্ছে আবার উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করে নৌকার মনোনয়ন পাওয়া এবং মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই আকন্দের নেতৃত্বে অপর একটি গ্রুপ ট্রাক মার্কা প্রতীককে সর্মথন দিচ্ছে।

ময়মনসিংহ-৬ (১৫১) আসন : ফুলবাড়িয়া উপজেলা নিয়ে ময়মনসিংহ-৬ আসন। সর্বমোট ৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধিতা করবেন। শক্ত প্রতিদ্বন্ধিতা হবে বর্তমানসহ ৫ বারের এমপি নৌকা মার্কা প্রতীকের মুসলেম উদ্দিনের সাথে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ট্রাক মার্কা প্রতীকের আব্দুল মালেক সরকারের। স্থানীয়রা স্বজনকে জানায়, এ আসনে ঈগল মার্কা নিয়ে সরব আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, নৌকা মার্কা প্রতীকের মোসলেম উদ্দিনের মেয়ে সেলিনা বেগম সালমা।, মেয়ের সঙ্গে দ্বন্ধে কপাল পুড়তে পারে বর্তমান এমপি মোসলেম উদ্দিনের।

ময়মনসিংহ-৭ (১৫২) আসন : ত্রিশাল উপজেলা নিয়ে ময়মনসিংহ ৭ আসন গঠিত। সর্বমোট প্রতিদ্বন্ধি ৪ জন। শক্ত প্রতিদ্বন্ধিতায় বর্তমানসহ দুইবারের এমপি নৌকা প্রতীকের হাফেজ মোঃ রুহুল আমিন মাদানী এবং পৌর মেয়র থেকে পদত্যাগ করা স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রাক মার্কা প্রার্থী এবিএম আনিসুজ্জামান।

ময়মনসিংহ-৮ (১৫৩) আসন : ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নিয়ে ময়মনসিংহ ৮ আসন গঠিত। সর্বমোট প্রতিদ্বন্ধি ৫ জন। গত দুইবারের ন্যায় এবারও আওয়ামী লীগ জাতীয় পাটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও তিনবারের এমপি ফকরুল ইমামের জন্য এ আসন ছেড়ে দিয়েছে। মূল প্রতিদ্বন্ধিতা হবে লাঙল মার্কা প্রতীকের ফকরুল ইমামের সাথে উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করা, আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী, ঈগল মার্কা প্রতীকের মাহমুদ হাসান সুমনের। আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জাতীয় পাটির প্রাথীকে সর্মথন দেওয়া নিয়ে ঈশ্বরগঞ্জ আওয়ামী লীগ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আওয়ামী দলীয় সাবেক এমপি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে একটি অংশ লাঙল মার্কাকে সর্মথন দিচ্ছে, ঈশ্বরগঞ্জ আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ ঈগল মার্কাকে সর্মথন দিচ্ছে।

ময়মনসিংহ-৯ (১৫৪) আসন : নান্দাইল উপজেলা ময়মনসিংহ-৯ আসন গঠিত। এই আসনে সর্ব মোট ৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধিতা করছে। আওয়ামী লীগ এই আসনে গত দুইবারের সাবেক এমপি আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহীনকে পরিবর্তন করে ৭ম ও ৯ম সংসদের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুল সালামকে মনোনয়ন দিয়েছে। মনোনয়ন না পেয়ে বর্তমান এমপি আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহীন ঈগল মার্কা নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে নৌকা মার্কার সাথে ঈগল মার্কার।

ময়মনসিংহ-১০ (১৫৫) আসন : গফরগাঁও উপজেলা নিয়ে ময়মনসিংহ-১০ গঠিত। এ আসনে সর্বমোট ৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন। এ আসনে নৌকা মার্কার প্রার্থী ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল টানা দুইবারের এমপি ও একবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তার পিতা আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ এই আসন থেকে টানা তিনবার এমপি ও একবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এই আসনের ঐতিহ্যবাহি রাজনৈতিক পরিবার গোলন্দাজ পরিবার থেকে ১৯৯০ সালের পর থেকে কেউ পরাজিত হয়নি। এই আসনে নৌকা মার্কার কর্মী-সর্মথকরা তাদের জয় শুধু সময়ের ব্যাপার মনে করছেন।

ময়মনসিংহ-১১ (১৫৬) আসন : ভালুকা উপজেলা নিয়ে ময়মনসিংহ -১১ আসন গঠিত। মোট প্রার্থী ১১ জন। শক্ত প্রতিদ্বন্ধিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে নৌকা মার্কা প্রতীকের বর্তমান এমপি কাজিম উদ্দিন আহম্মেদ ধনুর সাথে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, স্বতন্ত্র প্রাথী ট্রাক মার্কা প্রতীকের মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদের। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মোঃ গোলাম মোস্তফা নৌকার ভোট কেটে লড়াই জমিয়ে তুলতে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন।

ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতয়ি সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা সুষ্ঠ, শান্তিতপূর্ন ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিবে। ময়মনসিংহ জেলায় প্রায় সব আসনে আমাদের স্বতন্ত্র প্রাথী রয়েছে। দলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোন ধরনের বাধা নেই। তাদেরকেও প্রতিদ্বন্ধি হিসেবে ভাবতে হবে। তাদের প্রতি বৈরী মনোভাব দল সর্মথন করে না । তাদেরকে সর্মথন করতেও দলের নিষেধ নেই । যে বেশি ভোট পাবে সেই জয়লাভ করবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ময়মনসিংহ সদর, ত্রিশাল, ভালুকা ও গফরগাঁও আসনে ট্রাক মার্কা প্রতীকে সর্মথন করছি।